অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে পাঁচ কারণে টাকা পাচার হচ্ছে। এর মধ্যে দেশে বিনিয়োগের পরিবেশের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার শঙ্কা, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর দুর্বল নজরদারি, আইনের শাসনের ঘাটতি এবং বেপরোয়া দুর্নীতি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় টাকা পাচারের ক্ষেত্রে মোটা দাগে এসব কারণ উঠে এসেছে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, অর্থ পাচারের ইস্যুটি পুরোনো। বিভিন্ন সংস্থা থেকে টাকা পাচারের তথ্য আসছে। তিনি বলেন, দেশের মোট বিনিয়োগের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ আসে বেসরকারি খাত থেকে। কিন্তু গত কয়েক বছরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমছে। তিনি বলেন, বিনিয়োগের পরিবেশ নেই, যে কারণে টাকা পাচার হচ্ছে। অনেকেই এ দেশে টাকা রাখা নিরাপদ মনে করেন না। ফলে টাকা বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন। তার মতে, যন্ত্রপাতির মূল্য বেশি দেখিয়ে বিদেশে টাকা পাচার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে বিষয়টি অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ একবার বিদেশে টাকা গেলে, তা ফেরত আনা খুব কঠিন। তিনি আরও বলেন, সরকার তার ভাবমূর্তি হারানোর ভয়ে তথ্য লুকিয়ে রাখে। কিন্তু এগুলো করে লাভ হয় না। কারণ ভাবমূর্তি শেষ পর্যন্ত রক্ষা হয় না।
সাম্প্রতিক সময়ে পরপর তিনটি সংস্থার রিপোর্টেই বাংলাদেশ থেকে ভয়াবহ আকারে টাকা পাচারের তথ্য উঠে এসেছে। এগুলো হচ্ছে-জিএফআই, সুইস ব্যাংক এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন আইসিআইজের পানামা ও প্যারাডাইস পেপারস। বাংলাদেশ থেকে যেসব টাকা পাচার হয়, এর বড় অংশই যায় উন্নত ৩৬ দেশে। তবে দফায় দফায় রিপোর্ট প্রকাশ হলেও পাচার বন্ধে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই বলে মনে করেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। সরকারি সংস্থা বলছে, এসব তথ্যের ব্যাপারে তারা দ্বিধান্বিত। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান মাসুদ বিশ্বাস যুগান্তরকে বলেন, জিএফআই প্রতিবেদন কোন তথ্যের, সেটি নিয়ে আমরা কনফিউজড (দ্বিধান্বিত)। ফলে এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না।
সর্বশেষ জিএফআই বৃহস্পতিবার যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে টাকা পাচারের ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, ২০১৫ সালে বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের যে বাণিজ্য (আমদানি-রপ্তানি) হয়, এর প্রায় ১৮ শতাংশই পাচার হয়েছে, যা প্রায় তিনটি পদ্মা সেতুর ব্যয়ের সমান। আর গত ছয় বছরে দেশ থেকে ৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যা চলতি (২০২১-২০২২) জাতীয় বাজেটের প্রায় কাছাকাছি এবং দেশের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির দ্বিগুণ। তবে তিন বছর আন্তর্জাতিক সংস্থাকে এ ধরনের কোনো তথ্য দিচ্ছে না বাংলাদেশ। এ ব্যাপারে জিএফআই-এর সিনিয়র ইকোনমিস্ট রিক রাউডেন ইমেইলে জানান, অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশ জাতিসংঘে নিয়মিতভাবে বার্ষিক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের তথ্য দিয়ে আসছিল। কিন্তু ২০১৬, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালের কোনো তথ্য দেয়নি। ফলে বাংলাদেশের সবচেয়ে সাম্প্রতিক তথ্য পাওয়া যায়নি। যে কারণে ২০১৫ সালের তথ্য দিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে। সংস্থাটির তথ্য অনুসারে, আমদানি-রপ্তানির আড়ালে ২০০৯ সালে দেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫১২ কোটি, ২০১০ সালে ৬৮৪ কোটি, ২০১১ সালে ৮৭৩ কোটি ডলার। ২০১২ সালে ৭৬৪ কোটি, ২০১৩ সালে ৯৩৪ কোটি এবং ২০১৫ সালে ১ হাজার ১৮৭ কোটি ডলার পাচার হয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থ পাচারের তথ্যটি নতুন নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে সরকারের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। তাদের মতে, টাকা পাচার রোধে সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দরকার। তবে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতাহারে টাকা পাচার রোধে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। তবে সরকার বলছে, তারা পাচার রোধে কাজ করছে এবং ইতোমধ্যে বেশ অগ্রগতি হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে টাকা পাচারের এক ভয়াবহ তথ্য পাওয়া গেছে। আমদানির নামে এলসি বিল পরিশোধ করছে; কিন্তু কোনো পণ্যই দেশে আসছে না। প্রভাবশালী মহল পণ্য জাহাজীকরণের কাগজ জাল করে এলসি করা পণ্যের পুরো টাকাই তুলে নিয়ে বিদেশে রেখে দিচ্ছে। এ ধরনের বেশকিছু কেস স্টাডি পাওয়া গেছে। এগুলো পর্যালোচনার পর পাচার বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে।
দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশ থেকে প্রতিবছর যে টাকা পাচার হয়, এটি তার আংশিক চিত্র। পুরো চিত্র আরও ভয়াবহ। তার মতে, অর্থ পাচারের অনেক কারণ রয়েছে। এগুলো বন্ধের জন্য সরকারের সক্ষমতার অভাব হতে পারে। অথবা সরকারের সদিচ্ছা নেই। তিনি বলেন, মূলত দুর্নীতি হচ্ছে বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে। বিচার হচ্ছে না, এ কারণেই টাকা পাচার বাড়ছে। দুর্নীতিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার দৃষ্টান্ত নেই। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমাগতভাবে দুর্বল হচ্ছে। আইনের শাসনের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। এছাড়াও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে কিছু লোক বিদেশে টাকা নিতে পারে। দ্বিতীয়ত দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত কালোটাকা পাচার হতে পারে। এছাড়াও বিনিয়োগে মন্দার কারণে ব্যবসায়ীদের টাকা বিদেশে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, কারণ যাই হোক, টাকা পাচার হওয়া দেশের জন্য সুখবর নয়। তার মতে, সরকারের দুটি বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। টাকা ফিরিয়ে আনা এবং জড়িতদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক, দুদক, এনবিআর এবং অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসকে একযোগে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে পাচার রোধে আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটকে কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
গত বছরের জুনে প্রকাশিত সুইস ব্যাংকের রিপোর্ট অনুসারে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) পানামা, প্যারাডাইস এবং প্যানডোরা পেপারসে এ পর্যন্ত অর্থ পাচারকারী হিসাবে ৯০ জন ব্যবসায়ীর নাম প্রকাশ করেছে। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি দৃশ্যমান হয়নি বলে বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেন।
সূত্র জানায়, দেশে-বিদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন বন্ধ ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে তথ্যের আদান-প্রদান করতে ২০১৩ সালের জুলাইয়ে এগমন্ট গ্রুপের সদস্য হয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে ১৭০টি দেশ ওই গ্রুপের সদস্য। বাংলাদেশ এই গ্রুপের সদস্য হওয়ায় এখন সব দেশ থেকে মানি লন্ডারিং, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন বা টাকা পাচারবিষয়ক যে কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই।
পাচারে শীর্ষ দেশ : জিএফআইর প্রতিবেদন অনুসারে ২০১৮ সালে বিশ্বে অর্থ পাচারে প্রথম অবস্থানে চীন। এ সময় দেশটি থেকে ৩০৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা পোল্যান্ড থেকে পাচার হয়েছে ৬২ বিলিয়ন ডলার। এরপর ভারত ৩৮ বিলিয়ন, রাশিয়া ৩২ বিলিয়ন এবং মালয়েশিয়া ৩০ বিলিয়ন ডলার।
যেভাবে রিপোর্ট তৈরি করে জিএফআই : মূলত বিভিন্ন দেশ জাতিসংঘে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের যে তথ্য দেয়, তা বিশ্লেষণ করে জিএফআই। উদাহরণস্বরূপ, জাতিসংঘে দেওয়া বাংলাদেশের তথ্যে দেখা গেল, এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রে দুই বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া তথ্যে দেখা গেল তারা বাংলাদেশ থেকে তিন বিলিয়ন ডলার পণ্য কিনেছে। এই দুই দেশের আমদানি-রপ্তানির যে পার্থক্য, এটিকে পাচার হিসাবে বিবেচনা করে জিএফআই। এক্ষেত্রে ২০১৪, ২০১৬, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে জাতিসংঘে কোনো তথ্য দেয়নি বাংলাদেশ।