ভোলায় অবস্থানকারী ইমাম-মুয়াজ্জিনরা বর্তমানে কঠিন জীবন- সরকারি হিসাবে দেশে ১৯ হাজার ১৯৯টি কওমি মাদ্রাসা রয়েছে। বাস্তবে সংখ্যাটা হয়তো আরও একটু বেশি। সমাজের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী এসব মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। কওমি মাদ্রাসায় পড়াশোনা সম্পন্নকারীরা সাধারণত তিনটি কাজকে (কওমি সংশ্লিষ্টরা এসবকে ‘খেদমত’ আখ্যায়িত করেন) পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। তা হলো—ইমামতি, আজান দেওয়া ও মাদ্রাসায় শিক্ষকতা।
তবে সত্য হলো- তারা ইমামতি, আজান দেওয়া ও শিক্ষকতাকে যতটা না পেশা হিসেবে দেখেন তার চেয়ে এগুলোর প্রতি বেশি গুরুত্ব দেন দ্বীনের খেদমত মনে করে। তারা নিজেদের ইসলামের একেকজন একনিষ্ঠ খাদেম তথা সেবক মনে করেন। কেননা হাদিস শরিফে ইমাম, মুয়াজ্জিন ও শিক্ষকের মর্যাদা সম্পর্কে অসংখ্য ফজিলত ও পুরস্কারের কথা বর্ণিত রয়েছে। কওমি মাদ্রাসায় পড়ুয়া আলেমরা নিজেদের যে ইসলামের খাদেম মনে করেন, তার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত হলো– তাদের সাদাসিধে জীবনযাপন। মাদ্রাসা-মসজিদ থেকে যে হাদিয়া ও বেতন পান তা দিয়েই কোনোমতে সাধারণভাবে জীবন কাটিয়ে দেওয়াকে নিরাপদ মনে করেন। সারাদেশের এই বিপুল সংখ্যক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাদের অতিসাধারণ জীবনযাপনের মধ্য দিয়েই। এজন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, জৌলুসপূর্ণ অনেক মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতাদের নিজেদের বাড়িও থাকে টিনের তৈরি ও ভাঙাচোরা।
যদিও সমাজ তাদের এই বিরাট আত্মত্যাগ ও কোরবানির স্বীকৃতি দেয়। তারপরও সমাজের উচিৎ তাদের জীবনমান উন্নতিতে আরও মনোযোগ দেওয়া। তারা কী খান, কী পরিধান করেন, সন্তানদের পড়াশোনা করান কীভাবে—এসব যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেওয়ার দায়িত্ব সমাজের। কারণ অধিকাংশ মানুষ যখন স্বাচ্ছন্দ্য জীবনের সন্ধানে পৃথিবী চষে বেড়াচ্ছেন, তখন ইমাম-মুয়াজ্জিনরা নিজেদের মসজিদে আবদ্ধ রেখে সমাজের মানুষের ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করে চলেছেন এবং তাদের সন্তানদেরকে যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে নিয়োজিত রয়েছেন ওই শিক্ষকরাই। এককথায় বলা যায়, সমাজের সর্বস্তরের মুসলমান ইমাম, মুয়াজ্জিন ও শিক্ষকদের কাছে চিরঋণী। কিন্তু সত্য কথা হলো, মাদ্রাসা সংশ্লিষ্ট অল্পেতুষ্ট এই মানুষেরা বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনীতির মন্দাকালে তেমন ভালো নেই। যখন মোটামুটি অর্থশালী মানুষেরাই পরিবার নিয়ে জীবন পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছেন, তখন ইমাম, মুয়াজ্জিন ও শিক্ষকদের অল্প বেতনে জীবনযাপন করা বেশ কষ্টকর হয়ে পড়েছে। আত্মসম্মান, মর্যাদা ও পরকালীন জীবনের প্রতিদান প্রাপ্তির আশায় তারা এখনও ধৈর্যধারণ করে আছেন, যেভাবে নানা সঙ্কটে ইসলামের জন্য ধৈর্য ধরেছেন তাদের পূর্বপুরুষেরা।
বর্তমানে সঙ্কটকালে তারা কেমন আছেন—সেটি জানতে কথা হয় মসজিদ-মাদ্রাসার সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন আলেমের সঙ্গে। তাদের একজন মুফতি আবু তালহা। তিনি জেলার বাটামারার একটি মসজিদে প্রায় এক বছর যাবত ইমামতি করছেন। তিনি বললেন, ‘সাধারণত একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ তার যোগ্যতা অনুসারে যে চাকরিই করেন না কেন, ওই চাকরি থেকে পাওয়া বেতনে খুব সুন্দরভাবে তিনি সংসার চালাতে পারেন। কিন্তু আমাদের জন্য সেটি সম্ভব হয় না। কারণ, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়িয়ে আমি ৮ হাজার টাকা হাদিয়া পাই, তা দিয়ে পরিবার নিয়ে সংসার চালানো যায় কিনা আপনিও জানেন।’ মুফতি আবু তালহা কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ শিক্ষা স্তর দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স সমমান) সম্পন্ন করেছেন। এরপর হাদিস ও ইসলামি ফিকহে নিয়েছেন আরও দুইটি উচ্চতর ডিগ্রি। তিনি একটু স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য মসজিদে ইমামতির পাশাপাশি পাশেই একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। একজন মানুষের জন্য ইমামতির সঙ্গে সঙ্গে আবার শিক্ষকতা করা কতটা কঠিন, তা তার কথাতেই স্পষ্ট ফুটে উঠল।
ভোলা সদর শহরের অদূরে অবস্থিত বড় একটি মসজিদ। নাম বাইতুল হাসান। ওই মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব পালন করছেন মুফতি আবু রায়হান। তার বেতন ১০ হাজার টাকা। তিনিও পাশেই আরেকটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন, যাতে নিজের সংসারটা একটু স্বাচ্ছন্দ্যে চলে তাই এই কষ্ট মেনে নেওয়া তার। তবে জানা গেছে, ঢাকায় থেকে মুফতি আবু রায়হানের অনেক বন্ধু তার এই চাকরিটাকে খুব ভালো খেদমত মনে করেন। অনেকের ভাবনায়, তারা যদি এমন চাকরি পেতেন, তাহলে তাদের জীবনটা আরেকটু সচ্ছল হতে পারত। চরফ্যাশনে অবস্থিত বায়তুল মামুর জামে মসজিদ। ওই মসজিদের ইমাম মুফতি খালিদ সাইফুল্লাহ। এলাকাটিতে গ্রামের ছোঁয়া থাকায়, এখানে শহরের তুলনায় জীবনযাপনের ব্যয় কিছুটা সহনীয়। তবে মসজিদ থেকে যে ৯ হাজার টাকা দেওয়া হয়, তা দিয়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে সংসার চালাতে মুফতি খালিদ সাইফুল্লাহও নিরুপায়। তিনি জানালেন, সচ্ছলতার জন্য তিনি আলাদাভাবে বাচ্চাদের পড়ান। সেখান থেকে ও মসজিদ থেকে যা পান, তা দিয়ে দুই সন্তান, স্ত্রী ও মা-বাবাসহ সংসার চালাতে হয় তার। লালমোহনের একটি মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা ওবায়দুল্লাহ। ওই মাদ্রাসায় তার মতো শিক্ষকদের বেতন ১০ হাজার টাকার আশপাশে। মাওলানা ওবায়দুল্লাহ শিক্ষকতার পাশাপাশি বাইরে টিউশনি করেন। তবে জীবনটা আরেকটু স্বস্তির ও সচ্ছল হলে ভালো হতো বলে মনে করেন তিনি। এগুলো শহরের চিত্র। গ্রামে ইমাম-খতিবরা যেন আরও কঠিন পরিস্থিতির শিকার। মাওলানা দাউদ খান। তিনি ওই উপজেলার কোন্দারদিয়া গ্রামের ‘মেম্বরবাড়ি জামে মসজিদের খতিব। গ্রামের যে কয়েকটা মসজিদ সুন্দর হিসেবে নামকরা, তার মধ্যে এটি অন্যতম। মাসে চারটি জুমার নামাজ পড়িয়ে মাওলানা দাউদ খান হাদিয়া পান দেড় হাজার টাকা। তিনি বলেন, এ দিয়ে কিভাবে বর্তমানে একটি পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করা সম্ভব অথচ মুসলিম সমাজে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের উচ্চতর মর্যাদা দেয়া হয়েছে। কোন মুসলমান মারা গেলে তার দাফন কাফন ও জানাযায় আগে ডাক পরে ইমামদের। কিন্ত তাদের পেটে যে খাবার নেই সেই খবর কেউ রাখে না। সবাই নিজেদের প্রয়োজনে তাদেরকে ব্যহার করে। এটা দুঃখজনক।