এনামুল হক রাঙ্গা (বগুড়া) প্রতিনিধি: , আপলোডের সময় : শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ , আজকের সময় : বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪

উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় পাট চাষে আগ্রহ হারাচ্ছে প্রান্তিক চাষিরা

পাট কে দেশের সোনালী আশ বলা হয়, একসময় দেশে পাটের ব্যাপক চাষাবাদ করতো প্রান্তিক কৃষকরা। সময়ের ব্যবধানে সেই পাট চাষ আগের মতো এখন আর তেমন চোখে পড়েনা। তথাপিও বর্তমান সরকার  পাটের ওপর বরাবরই গুরুত্ব দিয়ে আসছে ।
গত কয়েক বছরের ব্যবধানে পাট চাষে  উত্তরের জেলা সহ  বগুড়ায়  মাঠের চিত্র ভিন্ন দেখা গেছে। উপযুক্ত দামের অভাবে কৃষকের কাছে আগ্রহ হারাচ্ছে পাটের আবাদ। গেল বছরের চেয়ে এবার মণ প্রতি পাটের দাম কমেছে অন্তত ৬০০ টাকা। বিপরীতে পাটের আবাদে খরচ বেড়েছে কৃষকের। আবার রপ্তানি না থাকায় পাইকারি ব্যবসায়ীরাও পাট ক্রয় করে পড়ছেন লোকসান ঝুঁকিতে। এমন পরিস্থিতিতে আগামিতে পাটের আবাদ ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছেন কৃষকেরা।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যেও দেখা যায়, জেলায় পাট চাষের পরিমাণ কমেছে। এবার উৎপাদন বেশি হলেও গত দু’বছর ধরে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি এই অর্থকরী ফসলে।
তবে জেলার কৃষি কর্মকর্তারা সোনালী আঁশ উৎপাদনে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে নিয়মিত প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছেন।
জেলা কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে বগুড়ায় পাট চাষে জমির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২ হাজার ৬৩৪ হেক্টর। বিপরীতে অর্জন হয় ১০ হাজার ৬৯০ হেক্টর। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩০ হাজার ৫১৭ মেট্রিক টন। জমি থেকে ফসলটি কাটা এখনও চলমান। তবে অর্জিত জমিতে উৎপাদনের হার পাওয়া যাচ্ছে ২ দশমিক ৮২ মেট্রিক টন করে। এ হিসাবে মোট উৎপাদন হতে পারে প্রায় ৩০ হাজার ১৪৬ মেট্রিক টন।
গত অর্থবছরে পাটের আবাদে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। ১৩ হাজার ৫০ হেক্টর জমির বিপরীতে অর্জন হয়েছিল ১১ হাজার ১৬৭ হেক্টর। আর উৎপাদন পাওয়া যায় ৩০ হাজার ৬৭৬ মেট্রিক টন।
এসব গেল পরিসংখ্যানের কথা। মাঠ পর্যায়ে কৃষকও বলছে পাটের উৎপাদন বৃদ্ধির কথা। বন্যা না থাকায় এবার ফলনে সমস্যা হয়নি। কিন্তু জমি থেকে ফসল কাটার পর হাট-বাজারে পাটের দাম দেখে হতাশ চাষীরা। গত সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতি মণ পাট বিক্রয় হয়েছে ১৮শ থেকে দুই হাজার টাকায়। তবে দু তিন দিন ধরে এই দাম একটু বেড়েছে।
গত রোববার বগুড়ার সারিয়াকান্দির মথুরাপাড়া হাটে গিয়ে দেখা যায় প্রতিমণ পাট কৃষকেরা বিক্রি করছেন ২২শ থেকে ২৪শ টাকায়। বগুড়ার সবচেয়ে বেশি পাট চাষ হয় এই উপজেলায়, এবারের পরিমাণ ৫ হাজার ৭১৫ হেক্টর। এ জন্য এখানে আশেপাশের অনেক পাইকারী ব্যবসায়ীরা আসেন পাট ক্রয় করতে।
তবে এসব দামে কৃষক সন্তুষ্ট নন। তাদের দাবি, দুই হাজার বা ২৪শ টাকায় পাট বিক্রয় করে তাদের খরচ পোষাচ্ছে না। পাট চাষে অন্য খরচ তেমন না থাকলেও কৃষি মজুরের খরচ বেশি। প্রতি বিঘায় চাষ থেকে শুরু করে পাট ঘরে তুলতে তিন দফায় অন্তত ১৪ জন শ্রমিক প্রয়োজন। শ্রমিক প্রতি এবার দিতে হয়েছে ৬০০ টাকা। আনুষঙ্গিক খরচ মিলে প্রতি বিঘা পাট চাষে খরচ পড়ে প্রায় ১০ হাজার টাকা। আবার হাটে আনা নেয়াতে আছে বাড়তি খরচ।
সারিয়াকান্দি উপজেলার বয়ড়াকান্দি গ্রামের ফজলুল হক বলেন, আমার ১০০ শতক জমিতে সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার টাকা। এখন দাম যাচ্ছে ১৮শ থেকে দুই হাজার টাকা মণ। এই দামে খরচ উঠবে না। এ রকম থাকলে আগামীতে এই ফসল আর করা যাবে না।
উপজেলার  মথুরা পাড়া গ্রামের আবুল প্রামানিক তিন বিঘা জমিতে পাট করেছেন। এর মধ্যে দুই বিঘা জমির পাট কেটে শুকাচ্ছেন। আবুল প্রামানিক বলেন, পাট এভাবে করা যাবি না। খরচা বেশি। কাটতে লাগে ৬০০ টাকা, উবাতে ৬০০, ধুইতে লাগে ৬০০ টাকা। বাজারেত দাম নাই। এখন বীজ, সারের দাম বেশি। আগে তো ১০০ টাকা মণ পাটও বেচছি। তখন ওই দামে খরচ পোষাতো। কিন্তু এখনতো খরচে পোষায় না।
মথুরাপাড়া হাটে নয় মণ পাট নিয়ে এসেছেন সারিয়াকান্দির মাঝিড়া চরের বাসিন্দা মোবারক আলী । এর মধ্যে ছয় মণ পাট ২৪শ টাকায় বিক্রি করেছেন। দাম কম বলায় বাকি তিন মণ পাট দিচ্ছেন না।
এই কৃষক বলেন, ‘এবার পাট ভালোই হছলো, কিন্তু কামলার মনায় (শ্রমিক খাত), নামানি, ধোয়াতেই ঘর থেকে ভর্তুকি গেছে।
রোববার মথুরাপাড়া হাটে পাট ক্রয় করতে এসেছেন ধুনট উপজেলার সোনামুখী গ্রামের পাইকারী ব্যবসায়ী সোহাগ বাবু। তিনি বলেন, আজকের বাজারে পাটের দাম একটু বেশি। ২৩শ থেকে ২৪শো টাকায় পাট ক্রয় করছি। সরকার গত বছর পাট নেয়নি। গত বছর পাটের দাম ৩২শ থেকে ৩৩শ টাকা ছিল। অনেকে কিনে রাখছিল, কিন্তু বেচতে পারেনি। এ জন্য এবার দাম ২২শ-২৩শ টাকা হয়। এবারও সরকার পাট না নিলে দাম আরও কমে যাবে। সরকার যদি পাট দেশের বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করে, তাহলে কৃষকের ভালো হবে। আমাদেরও ভালো।
মথুরাপাড়া হাটের আরেক পাইকারী ব্যবসায়ী মো. হায়দার আলী জানান, বিগত চার থেকে পাঁচ বছর সরাসরি পাট রপ্তানি বন্ধ আছে।
এই পাইকার বলেন, বিগত দুই তিন বছরের মধ্যে এবার পাটের মান ভালো। তবে পাটে যেমন খরচ হয় সেটা বিক্রয়ের দামে ওঠে না। আর আমরা কৃষকদের উপযুক্ত দাম দিতে পারছি না, আসলে আমরা তো পাট নিয়ে বিক্রি করি। যদি আমরা নায্য দাম পেতাম, তাহলে তাদেরকেও আমরা ভালো দাম দিতে পারতাম।
পাটের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সরকার বদ্ধপরিকল্প। এ লক্ষ্যে চলতি বছরে বগুড়ায় ১০ হাজার কৃষককে প্রণোদনা হিসেবে এক কেজি করে বীজ দেয়া হয়েছে বলে জানানজেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মতলুবর রহমান।
তিনি বলেন, মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টিপাত কম ছিল বিধায় পাট চাষীদের কিছুটা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবে মৌসুমের মাঝামাঝিতে এসে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হওয়ায় পাট পচানোর কাজ সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছে কৃষকেরা। তবে এবার ফলন ভালো হয়েছে। বিঘা প্রতি প্রায় ৯ মণের বেশি উৎপাদন হয়েছে। বর্তমানে পাটের মান ভেদে প্রতি মণে ২ হাজার থেকে ২৫শ টাকা দাম পাওয়া যাচ্ছে।
দাম কমের বিষয়ে এই কৃষিবিদের পরামর্শ, এখন সবেমাত্র জমি থেকে পাট কাটা শুরু হচ্ছে, এখন বাজারে বিক্রি না করে কিছুদিন সংরক্ষণ করা ভালো। তাহলে মাসখানেক পর পাটের বাজার চাঙ্গা হলে কৃষকরা ভালো দাম পাবেন।
রপ্তারির প্রসঙ্গে উপপরিচালক মতলুবর রহমান বলেন,  আমাদের দেশে বেসরকারি পর্যায়ে বেশ কিছু পাটের কল আছে, যারা কিনা পাটজাত দ্রব্য যেমন বস্তা তৈরি করে রপ্তানি করছে। যদি এই পাট রপ্তানিটা সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে আরও বাড়ানো যায় তাহলে আমাদের কৃষকরা যথেষ্ট ভালো দাম পাবে। এই যে একটা ভালো ফসল যা কিনা মাটির উর্বরতা বাড়ায় সেই ফসল চাষে কৃষকরা আরও উদ্বুদ্ধ হবে।
পাট রপ্তানির বিষয়ে কথা হয় বগুড়া চেম্বার অব কমার্সের সহ সভাপতি মাহফুজুল ইসলাম রাজ। তিনি বলেন, বগুড়ায় যেসব মিল-কারখানা আছে তারা পাটের ফিনিশড গুড (পাটজাত দ্রব্য) ইন্ডিয়াতে রপ্তানি করে থাকে। ইন্ডিয়াতে পাটের বিশাল মার্কেট রয়েছে। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্য ও অনেক দেশেই আমাদের পাটের ফিনিশড পন্য যায়।
আমরা বিশ্বাস করি কৃষকদের প্রণোদনার হার বাড়িয়ে দেয় এবং যে ফিনিশড গুড রপ্তানি হয় সেদিকে সরকার একটু সুনজর দেয়, আরও প্রণোদনার হার বাড়িয়ে দেয় তাহলে আগামিতে পাটে আরও বৈদেশিক মুদ্রা আসবে।
সরাসরি পাট রপ্তানির সুযোগ নিয়ে মাহফুজুল হক রাজ বলেন, সরাসরি পাট বহির্বিশ্বে আমরা বাইরে রপ্তানি করতে চাই, সেখানে পাটের ময়েশ্চারসহ রপ্তানির যে জায়গাগুলো আমাদের ফুলফিল করার দরকার, সেটি কৃষকের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। এটি বড় ব্যবসায়ীরা যারা সরাসরি পাট রপ্তানি করেন তারা পারেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে কৃষকরা সত্যিকার অর্থে লাভবান হবেন না। আমরা যেটি বিশ্বাস করি, আমাদের উৎপাদিত পাটকে কোনো পন্য বানিয়ে রপ্তানি করি, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রা যেমন বেশি আয় হয়। পাশাপাশি কৃষককে উৎপাদিত পাট রপ্তানির ক্ষেত্রে যেসব বাধা থাকে তা পার হতে হয় না। তাহলে কৃষকরা পাট চাষ করে লাভবান হতে পারবে।