নিজস্ব প্রতিবেদক: , আপলোডের সময় : মঙ্গলবার, ১২ মার্চ, ২০২৪ , আজকের সময় : সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকল্প পরিচালক এর দুর্নীতির অভিযোগের প্রতিবেদন প্রকাশ হয়নি ৪ মাসেও

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পানির গুণগতমান পরীক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মুন্সি হাসানুজ্জামানের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগে গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশ ৪ মাসেও বাস্তবায়ন হয়নি। নানা ভাবে প্রকল্প পরিচালক তার বিরুদ্ধে শাস্তিমুল ব্যবস্থা যাতে না নেয়া হয় ‍এনিয়ে দৌড় ঝাপে ব্যস্থ হয়ে পরেছেন বলে অভিযোগ ‍উঠেছে।

প্রকল্পের কেনাকাটায় এন্তার অনিয়ম ও প্রকল্প পরিচালকের সীমাহীন দুর্নীতির কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি। ল্যাবের যন্ত্রপাতি সরবরাহের আগেই ২৪ কোটি টাকা বিল পরিশোধসহ নিম্নমানের কাজ করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এসব বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। অভিযোগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, পিডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুদক চেয়ারম্যান বরাবরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, পরীক্ষাগারের বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি সরবরাহ পাওয়ার আগেই প্রকল্প পরিচালকের পছন্দের দুটি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ২৪ কোটি টাকা বিল প্রদানসহ দরপত্রে নানা অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে এলজিআরডি মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি। কেনাকাটায় অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং দরপত্র প্রক্রিয়ায় অদক্ষতার কারণে সংশ্লিষ্ট দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।

জানা গেছে, নিরাপদ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে দেশের ৫২টি জেলায় পানি পরীক্ষাগার স্থাপনের জন্য ১৭৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ব্যয়ে চার বছরের একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পের কাজ ২০২৪ সালের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কাজের অগ্রগতি তেমন একটা নেই। প্রকল্পটির আওতায় পরীক্ষাগারের জন্য যন্ত্রপাতি এবং রাসায়নিক দ্রব্যসহ বিভিন্ন যন্ত্র-সরঞ্জাম কেনার কথা। তবে প্রকল্পের কর্মকর্তাদের অনিয়ম ও অদক্ষতার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ আরো ১ বছর বাড়ানোর প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।

প্রকল্পের বিভিন্ন দরপত্রে অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্ম সচিব এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে আহ্বায়ক ও যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ ফজলে আজিমকে সদস্য সচিব করে গত বছর ২৩ অক্টোবর তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। তদন্ত কমিটি ১১ এপ্রিল দুই দফা সুপারিশসহ তদন্ত রিপোর্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কার্যাদেশ পাওয়া দুটি প্রতিষ্ঠানই প্রথম রানিং বিল প্রদানের পর এর সমপরিমাণ পণ্য বিভিন্ন সময়ে (জুলাই ২০২২ থেকে অক্টোবর ২০২২-এর মধ্যে) সরবরাহ করেছে, যা কার্যাদেশ পাওয়া দুটি প্রতিষ্ঠানের ডেলিভারি চালানে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের জেলা পর্যায় অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীর পণ্য বুঝে পাওয়ার স্বাক্ষর থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়।

সুতরাং রানিং বিল এবং ইনভয়েস, ডেলিভারি চালান ও পণ্য বুঝে পাওয়ার প্রমাণ থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে, ক্রয়কারী ক্রয়কৃত পণ্যের কোনো ধরনের সরবরাহ ছাড়াই ক্রয়কারী কার্যাদেশ পাওয়া দুটি প্রতিষ্ঠান কম্পিউটার ওয়ার্ল্ড বিডিকে ১৩ কোটি টাকা ও মেডি গ্রাফিক ট্রেডিং লিমিটেডকে ১০ কোটি ৭৪ লাখ ৮২ হাজার টাকার প্রথম বানিং বিল প্রদান করেছে, যা সম্পূর্ণ নিয়ম বহির্ভূত। এ ক্ষেত্রে অভিযোগকারীর অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে ক্রয়কারীর বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, টেন্ডার আইডি নম্বর ৬৩৭২৭৮ এবং ৬৮৬৯২৪-এর টেন্ডার ভ্যালিডিটি পিরিয়ড অতিক্রান্ত হয়েছে এবং টেন্ডার দুটি এখনও অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অদক্ষতার কারণে সংশ্লিষ্ট দরপত্র মূল্যায়ণ কমিটি ও ক্রয়কারীর বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, এর আগেও গত বছরের জুলাইয়ে প্রকল্পটিতে টেন্ডার অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ায় স্থানীয় সরকার বিভাগের পানি সরবরাহ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. খাইরুল ইসলামকে প্রধান করে গঠন করা হয় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি। ওই অনিয়মের সঙ্গে খোদ প্রতিষ্ঠানটির প্রকল্প পরিচালক সম্পৃক্ত বলে তদন্তের মতামতে উল্লেখ করা হয়।

দরপত্রে অংশগ্রহণকারী একটি প্রতিষ্ঠান স্টার্লিং মাল্টি টেকনোলজিস লিমিটেড (টেন্ডার আইডি ৬৪৭২৮ এবং ৬৪৬৯২৪) অনিয়মের অভিযোগ তোলে। তাদের দাবি ছিলো, সর্বনিম্ন দরে ৫ম স্থান থেকে তাদের বাদ দিয়ে অনিয়মের মাধ্যমে ৭ম স্থানে থাকা প্রতিষ্ঠানকে মনোনীত করা হয়। টেন্ডারে অ্যাপ ভ্যালু ২২ কোটি ৫০ লাখ টাকা উল্লেখ করা হয়। কিন্তু টেন্ডার বাজেট ২৮ কোটি ৮৪ লাখ ১৫ হাজার ৪০০ টাকা উল্লেখ করে টেকনোল্যাবকে মনোনীত করা হয়। প্রকল্প পরিচালক এই টেন্ডার দুটির জন্য কোনো টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করেননি। একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার জন্য তাদের স্পেসিফিকেশন হুবহু টেন্ডারে প্রকাশ করা হয়।

এছাড়া প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে মোটা অঙ্কের ঘুষ চাওয়ার অভিযোগও করা হয় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে। তদন্ত কমিটির সদস্যরা সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্তে উপনীত হন সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ও বর্তমান প্রকল্প পরিচালক মুন্সী হাসানুজ্জামান প্রকল্পে চরম অদক্ষতা, গাফিলতি, অপেশাদারি ও পক্ষপাতমূলক আচরণ করেছেন। পানির গুণগতমান পরীক্ষার ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের পণ্য প্যাকেজ ০৫ ও ০৬ দুটিকে ভেঙে ৪টি প্যাকেজ করা হয়েছে। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা-২০০৮-এর বিধি ১৭(৪) ও ১৭(৫) অনুযায়ী ডিপিপিতে অনুমোদিত কোনো একক কাজকে একাধিক প্যাকেজে বিভক্তিকরণের ক্ষেত্রে এইচ ও পিই-এর অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে। কাজেই বিষয়টি বিধি মোতাবেক কোনো টেন্ডার রি-ভ্যালুয়েশন কমিটি গঠন করা হয়নি।

যদিও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা-২০০৮-এর বিধি ৮(৩) অনুসারে অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক মূল্যায়ন কমিটি গঠন বাধ্যতামূলক। ৬৪৬৯২৪ নং দরপত্রে ৭ জন এবং দরপত্র ৬৪৭২৭৮-এ ৯ জন দরদাতা অংশ নেন। মূল্যায়ন সিট অনুসারে সর্বনিম্ন ক্রমিক ১, ২, ৩ ও ৪ দরদাতাদের অযোগ্যতা দেখা যায়। এ ছাড়াও, প্রকল্পটির মেশিনারিজ ও কেমিক্যালসহ বিভিন্ন উপকরণ থাকায় বিধি অনুসারে একটি টেকনিক্যাল কমিটি করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। পরপর দুটি মূল্যায়নের জন্য বিধি মোতাবেক কোনো টেন্ডার ওপেনিং কমিটি ও টেন্ডার ইভেলুয়েশন কমিটি গঠন না করে অনিয়ম করা হয়েছে।

তদন্ত কমিটি পানির গুণগতমান পরীক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের কার্যক্রম অনিয়ম হওয়ায় অন্যান্য দরপত্রে অংশগ্রহণকারীদেরও আইনগত প্রতিকারের সুপারিশ করেছে। তাছাড়া টেন্ডার ওপেনিং কমিটি ও টেন্ডার ইভেলুয়েশন কমিটি গঠন করে এ দরপত্র দুটি পুনঃমূল্যায়নেরও সুপারিশ করলেও তা মানা হয়নি। তার বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। অধিদপ্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীরা চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মুন্সি হাসানুজ্জামানের সাথে কথা বললে তিনি কান্ট্রিটুডেকে জানান অভিযোগের ভিত্তিতে দুদকসহ প্রতিষ্ঠানের তদন্ত কমিটি আমার কাছ থেকে প্রকল্পের প্রয়োজনিয় কাগজপত্র নিয়ে গেছে। কমিটি বিষয়টি দেখছে। তদন্ত কমিটি বিষয়টির ব্যপারে সিদ্ধান্ত নিবেন।