গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী পদে আছেন মোহাম্মদ শামীম আখতার। তাঁর চাকরির মেয়াদ আছে আরো প্রায় দেড় বছর। কিন্তু এখনই তাকে সরিয়ে এই পদে বসতে চান প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দীন আহাম্মদ । যিনি বহুল আলোচিত-কুখ্যাত জি কে শামীম সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রকৌশল) পদে আছেন মোসলেহ উদ্দীন আহাম্মদ।
গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী পদের জন্য বড় অংকের বাজেট নিয়ে নেমেছেন এই কর্মকর্তা এবং এ বাজেটের পরিমাণ ২০ কোটি টাকা বলে জানিয়েছেন তাঁর ঘনিষ্ঠরা। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিনের লোক হিসেবে পরিচিত ছিলেন প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন আহাম্মদ। মোছলেহ উদ্দীন নিশ্চিত ছিলেন যে, সচিব আরেক দফায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাচ্ছেন। সচিবের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হলেই এক সপ্তাহের মধ্যে প্রধান প্রকৌশলী পদে তিনি বসছেন, এটা মোটামুটি চাউর হয়ে গিয়েছিল । কিন্তু তা আর হয়ে উঠলো না। তবে তাই বলে বসে নেই প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দীন। তিনি এখন নতুন
কৌশলে একই মিশনে নেমেছেন।
সচিবের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ যখন আর বাড়লো না তারপর থেকে নতুন লাইনে হাঁটছেন তিনি। তাকে এই কাজে সহায়তা করছেন সাবেক মন্ত্রী ও সচিবের সুবিধাভোগী গণপূর্ত অধিদপ্তরের চিহ্নিত কিছু দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী। এই চক্রটি নতুন গণপূর্ত মন্ত্রীর এলাকার প্রভাবশালী লোকজন এবং আত্মীয়স্বজনের উপর ভর করেছে। এরা খুব শিগগিরই মোসলেহ উদ্দীন আহাম্মেদকে প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে দেখতে চায়। এর জন্য ব্যাপক তদবির ও লবিং চালিয়ে যাচ্ছে।
চাকরি জীবনের প্রায় শুরু থেকেই একজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে গণপূর্ত ক্যাডারের ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা মোসলেহ উদ্দীন। বিএনপি-জামায়াত আমলে জাতীয় সংসদ ভবনে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত থাকাকালে ব্যাপকহারে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
২০২০-২১ সালে গণপূর্তের বহুল আলোচিত-কুখ্যাত ঠিকাদার জি কে শামীম সিন্ডিকেটের হোতা হিসেবে বিশেষ পরিচিতি পান তিনি। গণপূর্ত অধিদপ্তরের ঢাকা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদে থাকাকালে মোসলেহ উদ্দিন আহাম্মদের অনিয়ম ও সীমাহীন দুর্নীতিতে অতীষ্ঠ হয়ে উঠে গণপূর্তের ঠিকাদার- ব্যবসায়ীরা পর্যন্ত। পুরো অধিদপ্তরে নতুন করে তার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে ‘ফিফটিন পার্সেন্ট’ নামে। প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়নে এই হারে কমিশন নিয়েছেন।
এমন বেপরোয়া দুর্নীতিপরায়ণ আচরণের কারণে তাকে পরে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। বিসিএস ১৫তম ব্যাচের প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন ১৯৯৫ সালে গণপূর্ত অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী পদে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে উপবিভাগীয় প্রকৌশলী হিসেবে ফেনী ও শেরেবাংলা নগরে দায়িত্ব পালন করেন। নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার পর শেরেবাংলা নগর ও দীর্ঘ সময় প্রধান প্রকৌশলীর স্টাফ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে সমন্বয় বিভাগে ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে চট্টগাম জোনেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সব জায়গাতেই দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের মধ্যে ২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর গুলশানের নিকেতনে জি কে শামীমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালায় র্যাব।
এ সময় ওই ভবন থেকে বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা, এফডিআর, আগ্নেয়াস্ত্র ও মদ উদ্ধার করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অভিযানে জি কে শামীম ও তার সাত দেহরক্ষীকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে জি কে শামীম যাদের নাম বলেছিলেন, তার মধ্যে মোসলেহ উদ্দিন অন্যতম। প্রথম সারির গণমাধ্যমে তখন এ তথ্য প্রকাশিত হয়। মোসলেহ উদ্দিন ছাত্রজীবনে ছাত্রদলের নেতা ছিলেন। বিএনপি ও চারদলীয় জোট সরকার আমলে তিনি বিএনপিপন্থী প্রকৌশলী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
তবে সে সব ছাপিয়ে এই আমলেও তিনি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সমর্থক পরিচয়ে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সবাইকে দাবিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। ২০০২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হিসাবে সংসদ ভবনে কর্মরত থাকা অবস্থায় তৎকালীন বিএনপি-জামাত জোট সরকারের ডেপুটি স্পিকার আখতার হামিদ সিদ্দিকীর বাসভবন সংলগ্ন তার গরু-ছাগল, হাস-মুরগির খামার গণপূর্তের টাকায় নির্মাণ করেন এবং গরুর ঘাস সরবরাহের নামে ৩ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেন। এ বিষয়ে দুদকে তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে অষ্টম জাতীয় সংসদে অনিয়ম দুর্নীতি তদন্তে অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়াকে (ডেপুটি স্পিকার) প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। ওই কমিটি গণপূর্ত বিভাগের ৩ প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছিল ওই কমিটি। কিন্তু সুপারিশ অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থা নেয়নি গণপূর্ত অধিদপ্তর। তদন্ত কমিটির সুপারিশে সাবেক স্পিকার জমির উদ্দিন সরকার ও ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট আখতার হামিদ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে মামলা হলেও তিন প্রকৌশলী ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন। বিএনপি-জামায়াত আমলের ক্ষমতাবান এই কর্মকর্তা আওয়ামী লীগ আমলেও শুরু থেকেই ক্ষমতার যাদুকাঠি পেয়ে যান।
তিন দফা পদোন্নতি পাওয়ার পর মোসলেহ উদ্দিনকে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হতে সহায়তা করেন কথিত যুবলীগ নেতা ও বিতর্কিত ঠিকাদার জি কে শামীম । তিন কোটি টাকা খরচ করে চট্টগ্রাম গণপূর্ত জোন থেকে ঢাকা গণপূর্ত জোনে বদলি হয়ে আসেন মোসলেহ উদ্দীন। গণপূর্ত অধিদপ্তরে কমিশনভোগী ‘ফিফটিন পার্সেন্ট’ নামে পরিচিতি পান। অভিযোগ রয়েছে, ঘুষ ও দুর্নীতির টাকায় অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ি করেছেন তিনি। ঢাকা ও কুমিল্লায় বাড়ি, ফ্ল্যাট ও জমি রয়েছে তার।
জানা যায়, জি কে শামীম সংশ্লিষ্ট দুর্নীতির কারণে মোসলেহ উদ্দীনকে ১৩ জানুয়ারি, ২০২০ তলবি নোটিশ পাঠায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের পরিচালক ক্সসয়দ ইকবাল হোসেন স্বাক্ষরিত নোটিশে বলা হয় ‘সরকারি কর্মকর্তাদের শত শত কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে বড় বড় ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন ঠিকাদার জি কে শামীমসহ অন্য ব্যক্তিরা। এর মধ্য দিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া ক্যাসিনো কান্ডে সঙ্গে জড়িয়ে শত শত কোটি টাকা আয় করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের ঘটনা ঘটেছে।
এসব অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে বক্তব্য নেওয়া জরুরি।’ এজন্য ১৬ জানুয়ারি, ২০২০ রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়েছিল মোসলেহ উদ্দীনকে। সেই অনুযায়ী হাজির হলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদের সময় গণপূর্ত অধিদপ্তরে ঠিকাদার- প্রকৌশলী সিন্ডিকেট, অতীতের অনিয়ম, দুর্নীতি, বিদেশে অর্থপাচার ও বাড়ির মালিক হওয়া, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সম্পদ গড়ে তোলার বিষয়ে নানা প্রশ্ন করা হয় তাকে। জিজ্ঞাসাবাদে নেতৃত্ব দেন দুদক কর্মকর্তা ক্সসয়দ ইকবালহোসেন। অর্থের প্রভাবে দুদকের সেই তদন্তও ধামাচাপা দিতে সক্ষম হন মোসলেহ উদ্দীন।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।