আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী দেশের প্রধান বিচারপতি নিয়োগের এখতিয়ার মহামান্য রাষ্ট্রপতির। এখানে আইন ও জ্যেষ্ঠতার কোনো বিষয় নেই।
মন্ত্রী আরও বলেন, আমার জানা মতে, এখনও কাউকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়নি। যদিও গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে খবর বেড়িয়েছে। তবে আগামীকাল ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ হতে পারে বলে তিনি জানান।
জাতীয় প্রেসক্লাবের আবদুস সালাম কনফারেন্স হলে আয়োজিত ‘মিট দ্যা ওকাব’ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আজ বৃহস্পতিবার এ কথা বলেন। ওভারসিজ করেসপন্ডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ওকাব) এই অনুষ্ঠান আয়োজন করে। ওকাব সংগঠক বিবিসি সংবাদদাতা সাংবাদিক কাদের কল্লোলের তত্ত্বাবধানে সংগঠনের সদস্য সচিব ডিআরইউ সভাপতি নজরুল ইসলাম মিঠু অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। অনুষ্ঠানে সিনিয়র সাংবাদিক ফরিদ হোসেন, ওকাব সদস্য ও বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সিনিয়র সাংবাদিক আনিসুর রহমানসহ সংগঠনের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
নির্বাচন কমিশন ও বিচারপতি নিয়োগ বিষয়ে আইন প্রণয়ন করা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আনিসুল হক বলেন, ‘আমরা স্বচ্ছ গভর্নেন্সে বিশ্বাস করি। আইন করা উচিৎ। তবে এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তড়িঘড়ি করে আইন প্রণয়ন সমীচিন হবে না।’
বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন অবসরে যাচ্ছেন। তাই নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ বিষয় নিয়ে প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘সংবিধানে দেশের প্রধান বিচারপতি নিয়োগের এখতিয়ার মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া আছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতিদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি একজনকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়ে থাকেন। এখানে আইন ও জ্যেষ্ঠতার কোনো বিষয় নেই।’
নির্বাচন কমিশন গঠন সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে যে, নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি। গত দুবার নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটা সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন হবে। দলগুলো নামগুলো দিতে পারবেন।
মন্ত্রী বলেন, ১০টি নাম সার্চ কমিটি সুপারিশ করতে পারবে, সেই ১০টি নাম থেকে পাঁচজনকে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নিয়োগ দেবেন। এভাবে গঠিত কমিশনের অধিনে দুটি নির্বাচন হয়েছে। তবে আমিও মনে করি, আইন হওয়া উচিত। সেটি তড়িঘড়ি করে করা সমীচিন হবে না। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণজনিত উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে সীমিত পরিসরে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় সংসদ বসলেও পরিস্থিতির কারণে সব সংসদ সদস্যকে সংসদে পাচ্ছিলাম না।
সংসদকে পাশ কাটিয়ে নির্বাচন কমিশন নিয়ে আইন করা ঠিক হবে না বলে মনে করেন আইনমন্ত্রী।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসা বিষয়ে সুযোগ প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, যে মামলায় খালেদা জিয়া সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন, সেটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মামলা হয়েছে। ২০১২ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন সেই মামলার প্রতিবেদন দেয়। মামলাটির বিচার কার্যক্রম চলাকালে তারা অন্তত ১০ বার হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে আবেদন করেছে মামলা স্থগিত করার জন্য। অনেক বিচারকের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করেছেন। সব কিছুর পর রায় হয়েছে। একটি মামলায় বিচারিক আদালতে সাজা পাঁচ বছর, হাইকোর্টে সেটি বেড়ে ১০ বছর হয়েছে। আরেকটা মামলার পরে খালেদা জিয়ার সাত বছর সাজা হয়েছে।
আইনমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়া যখন সাজা ভোগ করছিলেন তখন প্রধানমন্ত্রী মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে শর্তসাপেক্ষে সাজা স্থগিত রেখে, তাঁকে মুক্তি দেন। এখন তাঁকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে প্রেরণে বিদ্যমান আইনে সুযোগ বিষয়ে আমার মতামত আমি দিয়েছি।
খালেদা জিয়াকে মুক্তি বিষয়ে তাঁর স্বজনরা আবেদন করেছিলেন। তাঁরা প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তাদের আবেদনে আইনের উল্লেখ ছিল না। সরকার ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় শর্তসাপেক্ষে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়। দণ্ডাদেশ স্থগিত করে খালেদা জিয়ার মুক্তি সরকার মানবিক দিক বিবেচনা করেই দিয়েছেন। সরকার কোনো কাজই আইনের বাইরে করতে পারে না।
আনিসুল হক বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হওয়ার আগে এখন ইনকোয়ারির জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সেলে যাচ্ছে। যদি অভিযোগ মামলা করার মতো হয় তাহলে মামলা আদালতে যাবে।
আইনমন্ত্রী বলেন, এখন কিন্তু কোনো সাংবাদিককে মামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। আগে যাচাই করা হয়। এই আইন সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য করা হয়নি। তিনি বলেন, এই আইনের অপব্যবহার যাতে বন্ধ হয় সেজন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
আইনমন্ত্রী এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, দেশে আমার জানা মতে, এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং হয়নি। গণমাধ্যমে এরূপ ২৪১টা ঘটনার বিষয়ে প্রতিবেদন আসে। আমরা খতিয়ে দেখে এর মধ্যে দেখা যায় ২৩৯টাই মিথ্যা। বাকি দুটির সত্যতা পাই।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের বিষয়ে নয়, দুজন ব্যক্তির বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বলে জেনেছি। তারা র্যাবের কার্যক্রম নিয়ে প্রশংসা করেছেন।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ হয়। তখন পর্যাপ্ত অবকাঠামো ছিল না। শেখ হাসিনার সরকার পর্যাপ্ত অবকাঠামো নির্মাণ করেছেন। অবকাঠামোসহ অন্যান্য লজিস্টিক সাপোর্ট বৃদ্ধিতে নানা পদক্ষেপ তুলে ধরেন আইনমন্ত্রী। তিনি বলেন, লাখ লাখ মামলার জট ছিল। অবকাঠামো ও লজিস্টিক সাপোর্ট বৃদ্ধিতে তা এখন কমে আসছে।
আইনমন্ত্রী বলেন, দেশ ডিজিটাল যুগে পদার্পণ করেছে। ডিজিটাল প্লাটফরমে সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতে ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে চলছে। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসজনিত উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গোটা দুনিয়ায় আমার জানা মতে তিনটি দেশে বিচার বিভাগ সচল ছিল। আমাদেরও করোনার কারণে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ থেকে লং ভেকেশনে যেতে হয়েছে। তখন মানুষের ন্যায়বিচার নিশ্চিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ভার্চুয়াল ব্যবস্থা চালু করে বিচার ব্যবস্থা সচল রাখা হয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, এজন্য প্রথমে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ জারি এবং পরে এটিকে আইনে পরিণত করা হয়।
আইনমন্ত্রী বলেন, বিদ্যমান সাক্ষ্য আইনকে আরও যুগোপযোগী করে এর সংশোধনী আনা হচ্ছে। ধর্ষণের শিকার নারীকে জেরায় অবমাননাকর বিদ্যমান উপধারাটি বাতিল (রিমোভ) করা হচ্ছে। আগামী সংসদ অধিবেশনে আইনটি সংসদে উঠবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন আইনমন্ত্রী।