নিজস্ব প্রতিবেদক: , আপলোডের সময় : সোমবার, ১৫ আগস্ট, ২০২২ , আজকের সময় : শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

মানুষের কষ্ট আমরা উপলব্ধি করতে পারছি : প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক:

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে নিষেধাজ্ঞা-পাল্টা নিষেধাজ্ঞা মানুষের জীবনে সর্বনাশ ডেকে এনেছে মন্তব্য করে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কেবল আমরা ভুক্তভোগী নই, সারা বিশ্বের মানুষই ভুক্তভোগী। মানুষের যে কষ্ট হচ্ছে সেটা আমরা উপলব্ধি করতে পারছি। সেই কষ্ট লাঘবের জন্য আরও কী কী করা যায় তার জন্য প্রতিনিয়ত আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমরা মানুষের কষ্টটা যে বুঝি না, তা নয়।

রোববার (১৪ আগস্ট) প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের তো কিছু লোক থাকেই, প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে খামোখা জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়, ওই ছুতা ধরে— সেটা হচ্ছে কিছু কিছু। হঠাৎ এত দাম তো বাড়ার কথা নয় প্রত্যেক জিনিসের।

তিনি বলেন, আমাদের বিরোধীরাও একটা সুযোগ পাচ্ছে। তারা আন্দোলন করছে। সেটা করুক, আমি তো চাচ্ছি, আমি নির্দেশ দিয়েছি— তারা আন্দোলন করছে, করতে দাও। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও করবে, আমি আসতে দেব। খবরদার, তাদের কাউকে যেন গ্রেপ্তার করা না হয়, বিরক্ত করা না হয়। তারা আন্দোলন করতে চায়, করুক, অসুবিধা কী?

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যে আন্তরিকতার সঙ্গে মানুষের জন্য কাজ করছি, সেটা দেশের মানুষ জানে ও বোঝে। বিরোধী দল সুযোগ যখন পাচ্ছে, সেটা কাজে লাগাতে চেষ্টা করবে। কিন্তু তারা যদি বেশি করতে চায়, এর প্রভাবে তো দেশের মানুষের কষ্ট আরও বাড়বে। এটাও তাদের বোঝা উচিত।

বিরোধী দলের আন্দোলনের সফলতা নিয়ে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, আন্দোলন করে তারা কতটুকু সফল হবে সেটা জানি না। কিন্তু যেটা করছে তাতে দেশের জন্য আরও ক্ষতি হবে। আমরা সেটা সামাল দিতে পারব, সেই বিশ্বাস আমার আছে।

যখনই বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমবে সরকার তাতে সমন্বয় করবে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, সেটা আমার নির্দেশ রয়েছে, তা করে দিচ্ছি। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবহার সীমিত করতে হবে। হয়তো কিছুদিন আমাদের কষ্ট করতে হবে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যখন চালু হবে তখন বিদ্যুতের সমস্যা অনেকটা দূর হয়ে যাবে।

নির্বাচনি ইশতেহার পূরণ করা হয়েছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা যা যা ওয়াদা দিয়েছি সেগুলো পূরণ করেছি। করোনাভাইরাস, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং নিষেধাজ্ঞা না থাকলে দেশের কোনো সমস্যা হতো না।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে বিষয়গুলোতে আমরা আমদানি-নির্ভর সেখানে সমস্যা দেখা দিয়েছে। নিজ নিজ জমিতে সবাইকে উৎপাদন করতে হবে। আমাদের খাবারটা যেন আমরা নিজেরাই উৎপাদন করতে পারি, বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে না হয়, সেই ব্যবস্থাটাই আমাদের নিতে হবে।

নিষেধাজ্ঞায় আমেরিকা ও রাশিয়ার লাভ হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, রুবলের দামও বাড়ছে, ডলারের দামও বাড়ছে। বিশ্বব্যাপী রুবল ও ডলার স্টক হয়ে গেছে। মরছে সব দেশের সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জন্য চরম দুর্ভোগ। সব দেশের একই অবস্থা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা নিষেধাজ্ঞা ও যুদ্ধ মানুষের জীবনে সর্বনাশটা ডেকে এনেছে।

শেখ হাসিনা বলেন, ১৫ আগস্ট কারবালার চেয়েও জঘন্য হত্যাকাণ্ড ঘটে। আমার শুধু একটা প্রশ্নই জাগে মনে যে, আমার বাবা-মা-ভাইয়েরা কী অপরাধটা করেছিল? কেন এভাবে হত্যা করা হলো? এই শূন্য হাতে একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ এবং একটা প্রদেশ, তাকে রাষ্ট্রে উন্নীত করা এবং এই বিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা.. হাতে সময় পেলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর, কোনো সম্পদ ছিল না।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি (বঙ্গবন্ধু) শুধু একটা কথাই বলেছিলেন, মাটি আর মানুষ হচ্ছে আমার সম্পদ। এই মাটি আর মানুষের ওপর নির্ভর করেই কিন্তু তিনি সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সেই বিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলে স্বল্পোন্নত দেশে উন্নীত করে দিয়ে যান। তার লক্ষ্য ছিল, ঘুণে ধরা সমাজ ভেঙে একটা নতুন সমাজ দেবেন, এই ঔপনিবেশিক আমলের যে প্রশাসনিক কাঠামো সেটা ভেঙে গণমুখী প্রশাসনিক কাঠামো তিনি করতে চেয়েছিলেন। গণমুখী প্রশাসনিক কাঠামো করার জন্য একটা বিরাট পরিবর্তন তিনি আনতে চেয়েছিলেন। এই গণমুখী প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলে ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণ করে তিনি তৃণমূলের মানুষের কাছে ক্ষমতা দিতে চেয়েছিলেন।

তিনি বলেন, যে জন্য বাংলাদেশের প্রত্যেকটা মহকুমাকে জেলায় রূপান্তর করলেন এবং একেকটা জেলার উন্নয়নটা যাতে ওই জেলার ভিত্তিতে হয়, যাতে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর হয়, আর্থ-সামাজিক উন্নতি হয় সেই পদক্ষেপটাই তিনি নিলেন এবং দ্বিতীয় বিপ্লবের যে ডাকটা দিলেন সেটার লক্ষ্যই ছিল জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা, উৎপাদন বৃদ্ধি করা, আর্থ-সামাজিক উন্নতি করা। মনে হয় যেন এই দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কেউ যদি কোনো অবদান রাখতে যায় তাকে বোধহয় বিপর্যয়ে পড়তে হয়। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। এটাই হচ্ছে আমাদের জন্য সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের যে, যখনই এই দেশের মানুষ একটু ভালো থাকে, ভালো অবস্থায় আসে তখনই যেন চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রটা শুরু হয়।

সরকার প্রধান বলেন, একটা শ্রেণি সবসময় রয়ে গেছে এই দেশে, যারা এই দেশের মানুষের কল্যাণ হোক এটা চায় না। অর্থাৎ স্বাধীনতাটা অর্থবহ হোক, স্বাধীনতার সুফল বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে যাক- এখানে একটা বাধা দেওয়ার প্রচেষ্টা সব সময় আমরা দেখি। সেজন্য যখনই মানুষ একটু ভালো থাকে তখনই এগুলো (ষড়যন্ত্র) শুরু হয়।

সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগকে সুসংহত করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই সংগঠনের মাধ্যমেই তো আমরা কাজ করি। আমাদের যে কোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাক যাই আসুক আওয়ামী লীগের বা আমাদের সহযোগী সংগঠন সবসময় তারা কিন্তু সজাগ থাকে এবং মানুষের পাশে সবার আগে দাঁড়ায়। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। সেই সংগঠনকে সুসংহত করা— এটাই হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য।

তিনি বলেন, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ যখন সরকারে ছিল, আমাদের যখন মেয়াদকাল শেষ হয়ে যায় তখন আমরা কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে আসি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ পর্যন্ত আর কখনোই ক্ষমতার পরিবর্তন এভাবে শান্তিপূর্ণভাবে হয়নি। প্রতিবারই কিন্তু একেকটা ঘটনার মধ্য দিয়ে ঘটেছে। এটা কিন্তু সবার একটু মাথায় রাখতে হবে। এর কারণ আওয়ামী লীগ সবসময় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, নীতিতে বিশ্বাস করে। জনগণের ক্ষমতায় বিশ্বাস করে। সেজন্য ওই একবারই… তারপরের ঘটনা তো সবাই জানে।

আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ২০০১ সালের নির্বাচন। সেই সময়ে আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর অত্যাচার, মানুষ খুন করা, সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার- সেখানে হিন্দু-খ্রিস্টান কেউ বাদ যায়নি। ২০০১ সালের নির্বাচনের যে চিত্র সেটি সবার মনে আছে। তারপর বিএনপি-জামায়াত এসে বাংলাদেশকে পাঁচ পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, বোমা হামলা। ১৫ আগস্টের খুনিদের জিয়াউর রহমান যে শুধু ইনডেমনিটি দিয়ে মাফ করে দিয়ে পুরস্কৃত করেছে তা তো নয়। এরশাদ এসে খুনি ফারুককে প্রেসিডেন্ট ক্যান্ডিডেট করল। খালেদা জিয়া এসে আরও একধাপ ওপরে। রশিদ-ফারুক-হুদা তিনজনকে নমিনেশন। ফারুককে জেতাতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সেটা পারেনি। হুদা আর রশিদকে জিতিয়ে পার্লামেন্টে বসাল।

তিনি বলেন, খুনি রশিদকে পার্লামেন্টের লিডার অব অপজিশনে বসাল। তার মানে এই দেশে খুনিদের সৌহার্দ্য কত এটা জনগণের জানা উচিত। সেই খুনিদের তারা পুরস্কৃত করার মানে কী? ১৫ আগস্ট হত্যার সঙ্গে এদের যে সম্পৃক্ততা, জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততা, ইনডেমনিটি দিয়ে তাদের বিচার হবে না। আমরা যারা পনের আগস্ট আপনজন হারিয়েছি আমাদের তো বিচার চাওয়ার অধিকার ছিল না। মামলা করার অধিকার ছিল না, তাদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। অর্থাৎ বিচারহীনতার একটা সংস্কৃতি এ দেশে চালু করে দিয়েছিল। যেখানে তুমি কোনো দিন ন্যায় বিচার চাইতেই পারবে না। খুব ইয়ে লাগে যখন কেউ মারা গেলে আমার কাছে বিচার চায়। আমার তো বিচার পেতে ৩৫ বছর সময় লেগেছে। আমার বাপ, মা, ভাই- সব হারানোর পরেও বিচার চাইতে পারিনি।

মানুষের সেবায় আওয়ামী লীগ সরকার সবসময় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ফলে জনগণের আস্থা-বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছি। তারা আমাদের বারবার ভোট দিয়েছে, তাই টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছি। দারিদ্র্যের হার কমেছে, পুষ্টি নিশ্চয়তাসহ মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, এই দেশে আমার আব্বাই শুরু করেছিলেন ভূমিহীনদের মাঝে জমি দেওয়া এবং ঘর করে দেওয়া, সেটাই আমি সম্পূর্ণভাবে করতে চাই। আশ্রয়ণ নাম দিয়ে সেটা করে যাচ্ছি। ফলে বাংলাদেশে আগামীতে একটি মানুষও ভূমিহীন ও গৃহহীন থাকবে না।

তিনি বলেন, আমার আব্বা তো সারা জীবন এই দেশের মানুষের জন্য ত্যাগ শিকার করে গেছেন। শেষ পর্যন্ত জীবনটাই দিয়ে গেছেন। একটা মানুষ ঘর পাওয়ার পর তার মুখের হাসি ও তৃপ্তিটা আমার মনে হয় আমার বাবা বেহশত থেকে দেখেন। তার মনটাও নিশ্চয়ই তৃপ্ত হয় যে, দেশের মানুষ কিছু পাচ্ছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি আগেও বলেছি, আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে রাশিয়াকে শায়েস্তা করার জন্য। কিন্তু দেখা যাচ্ছে শায়েস্তা হচ্ছে সাধারণ মানুষ। শুধু আমরা নই, ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ প্রত্যেকটা মহাদেশের মানুষের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।