অনলাইন ডেস্ক: , আপলোডের সময় : রবিবার, ৯ অক্টোবর, ২০২২ , আজকের সময় : শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

৯৬০ কোটি টাকায় দেশের প্রথম ৬ লেনের মধুমতি সেতু

নড়াইলবাসীর দীর্ঘ দিনের প্রতীক্ষার অবসান হতে যাচ্ছে। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর পর এবার উদ্বোধন হতে যাচ্ছে দক্ষিণের দুয়ার খ্যাত কালনা সেতু। কালনা সেতুর নামকরণ করা হয়েছে ‘মধুমতি সেতু’। দেশের প্রথম ছয় লেনের সেতু এটি।

আগামীকাল সোমবার (১০ অক্টোবর) সকালে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি মধুমতি সেতু উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেতুটি উদ্বোধন হলে দেশের ১০ জেলা তথা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলবাসীর আরেকটি স্বপ্নপূরণ হবে।

সেতু কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নড়াইল জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা লোহাগড়া উপজেলার কালনা। অপরপ্রান্তে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার শংকরপাশা। মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে মধুমতি নদী। এ নদীর ওপরই নির্মিত হয়েছে দেশের প্রথম ছয় লেনের দৃষ্টিনন্দন মধুমতি সেতু।

কালনাঘাটে স্থাপিত নামফলক থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মধুমতি সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর নির্মাণ কাজ শুরু করে জাপান ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশন এজেন্সির (জাইকা) সহযোগিতায় ও দেশীয় অর্থে সেতুটি নির্মাণ করছে জাপানের টেককেন করপোরেশন ওয়াইবিসি জেভি কোম্পানি ও বাংলাদেশের আব্দুল মোনেম লিমিটেড। মধুমতি সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে শেষ হবে কালনা ফেরি ঘাটের দীর্ঘদিনের জন দুর্ভোগ।

দৃষ্টিনন্দন নেলসন লোসআর্চ টাইপের (ধনুকের মতো বাঁকা) মধুমতি সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) নড়াইলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মধুমতি সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলার বহুল আকাঙ্ক্ষিত একটি সেতু। আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হলেও নড়াইল ও যশোর থেকে শুরু করে ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলার মানুষ এর (পদ্মা সেতু) পুরোপুরি সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। মধুমতি সেতু চালু হলে পদ্মা সেতুর শতভাগ সুফল দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে।

তিনি বলেন, আমাদের এই মধুমতি সেতু সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬৯০ মিটার এবং প্রস্থ ২৭ দশমিক ১ মিটার, যেটি বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে চওড়া সেতু। এই সেতুতে মোট ১৩টি স্প্যান রয়েছে। সেতুর মাঝখানে ধনুকের মত বাঁকা ১৫০ মিটার দীর্ঘ স্টিলের স্প্যান সুদৃশ্য ডিজাইন করে বসানো হয়েছে। নেলসন লোসআর্চ টাইপের (ধনুকের মতো বাঁকা) এ স্প্যানটি তৈরি হয়েছে ভিয়েতনামে।

উভয় পাশে ছয় লেনের সংযোগ সড়ক প্রায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার। সংযোগ সড়কের বাঁকগুলো যানবাহন চলাচলের নিরাপত্তার বিষয় মাথায় রেখে দুর্ঘটনা রোধে আট লেনের সমান প্রস্থ রাখা হয়েছে। দ্রুতগতির যানবাহনের জন্য চার লেন ও ধীর গতির যানবাহনের জন্য দুই লেন মোট ছয় লেন বিশিষ্ট সেতুর নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছে ৯৫৯ কোটি টাকা ৮৫ লাখ টাকা।

সেতুর গুরুত্ব পর্যালোচনায় আশরাফুজ্জামান বলেন, এশিয়ান হাইওয়ের ওপর অবস্থিত এটি। এই সেতুটি শুধু জাতীয়ভাবে নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। এশিয়ান হাইওয়ে তুরস্কের ইস্তাম্বুল থেকে শুরু হয়ে জাপানে গিয়ে শেষ হয়েছে। সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সেতু এই সেতুর মাধ্যমে ঢাকা-সিলেট-তামাবিল সড়কের ‘আঞ্চলিক যোগাযোগ’ স্থাপিত হবে। কলকাতা, আসামসহ দেশের মধ্যে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর, বেনাপোল ও নোয়াপাড়া নদী বন্দরের মধ্যে যোগাযোগের মাইলফলক রচিত হবে। নড়াইলের লোহাগড়ায় ইপিজেড (রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল) চালুসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। ১০ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী সেতুটি উদ্বোধন করার পর যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শোভন ও কেয়া জানান, ফেরির জন্য আর ভোগান্তি পোহাতে হবে না। যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হবে না। তাদের এলাকার কৃষকরা উৎপাদিত কৃষি পণ্য দ্রুত স্থানান্তর করে ন্যায্যমূল্য পাবেন যেমনি, অন্যদিকে এই সেতুর কারণেএলাকায় কলকারখানা গড়ে উঠে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র প্রলয় বলে, আমাদের নদী পারাপারে অনেক ভয় লাগতো, এখন থেকে আর নৌকায় পার হতে হবে না। আমরা ব্রিজ দিয়ে পার হয়ে যাব। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই।

ট্রাকের হেল্পার সুমন জানান, সেতু উদ্বোধনের খবরে জনগণের চেয়ে পরিবহন সেক্টরের লোকজন বেশি খুশি। কারণ ফেরি ঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোড গাড়ি নিয়ে আর বসে থাকতে হবে না।

বাসচালক বাবু মিয়া বলেন, মধুমতি সেতু উদ্বোধন হলে আমাদের আর কষ্ট হবে না। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় আনন্দের।

কালনাঘাট থেকে ঢাকার দুরত্ব মাত্র ১০৮ কিলোমিটার। ফলে মধুমতি সেতু উদ্বোধন হলে ঢাকার সঙ্গে নড়াইল, বেনাপোল, যশোর, খুলনাসহ আশপাশের সড়ক যোগাযোগ কোথাও ১০০ কিলোমিটার, কোথাও আবার ২০০ কিলোমিটার কমে যাবে।

লোহাগড়া পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মশিউর রহমান বলেন, মধুমতি সেতু মূলত গোপালগঞ্জ জেলায় হলেও এই সেতুর সুফল ভোগ করবে দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলার মানুষ। তাই এই অঞ্চলের প্রবেশদার খ্যাত মধুমতি সেতু দ্বারা আমরা নড়াইলবাসী বেশি উপকৃত হবো। প্রধানমন্ত্রী যে কথা দিয়েছিলেন তা তিনি রেখেছেন। আমাদের বহুল কাঙ্ক্ষিত মধুমতি সেতু উপহার দেওয়ায় নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগ তথা নড়াইলের জনগণের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই।

তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তজার মাধ্যমে ইপিজেডের ঘোষণা দিয়েছেন। মধুমতি সেতু উদ্বোধনের পর খুব দ্রুত ইপিজেডের কাজ শুরু হবে বলে আশা করি।
মধুমতি সেতু প্রধানমন্ত্রীর জেলায় অবস্থিত হওয়ার পরও সকল আনুষ্ঠানিকতা নড়াইল অংশে হওয়ায় আমরা আনন্দিত।

সেতু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সেতুটি উদ্বোধনের পর যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে। সেতুর টোল হার নির্ধারণ করা হয়েছে বড় ট্রেইলার ৫৬৫ টাকা, তিন বা ততোধিক এক্সসেল বিশিষ্ট ট্রাক ৪৫০ টাকা, দুই এক্সসেল বিশিষ্ট মিডিয়াম ট্রাক ২২৫ টাকা, ছোট ট্রাক ১৭০ টাকা, কৃষি কাজে ব্যবহৃত পাওয়ার ট্রিলার ও ট্রাক্টর ১৩৫ টাকা, বড় বাসের ক্ষেত্রে ২০৫ টাকা, মিনিবাস বা কোস্টার ১১৫ টাকা, মাইক্রোবাস, পিকআপ, কনভারশনকৃত জিপ ও রে-কার ৯০ টাকা, প্রাইভেটকার ৫৫ টাকা, অটো টেম্পু, সিএনজি অটোরিকশা, অটোভ্যান ও ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যান ২৫ টাকা, মোটরসাইকেল ১০ টাকা এবং রিক্সা, ভ্যান ও বাইসাইকেল ৫ টাকা।

জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, মধুমতি সেতুটি ভৌগোলিক অবস্থানজনিত কারণে গোপালগঞ্জ জেলায় হলেও নড়াইলবাসী তথা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলা সরাসরি এর সুফল ভোগ করবে। দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দরসহ সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর এই সেতু দ্বারা সংযুক্ত হলো। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সকল ক্ষেত্রে এই অঞ্চলের মানুষের আশীর্বাদ হয়ে কাজ করবে এই সেতুটি।