প্রতিবেশী সেরেকুল মণ্ডলের মাদকাসক্ত ছেলে রোমানের সঙ্গে নাবালিকা মেয়ের বিয়েতে রাজি না হওয়ায় হারাতে হলো শিশু বায়েজিদকে (৪)৷ বায়েজিদের মায়ের দাবিই অবশেষে সত্যি প্রমানিত হলো।
চার বছরের শিশু বায়েজিদ নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই রোমানের পরিবার ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করে আসছিলেন শিশু বায়েজিদের হতভাগা মা রায়াহানা বেগম।
গত মঙ্গলবার (১৬ মে) দুপুরে নিজ কার্যালয়ে বায়েজিদ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনের সর্বশেষ তথ্য জানান গাইবান্ধা পুলিশ সুপার কামাল হোসেন।
সেখানে শিশু বায়েজিদের মায়ের দাবির পুরোপুরি সত্যতা মেলে। পুলিশ সুপার কামাল হোসেন জানান, ৮ মে বিকেলে শিশু বায়েজিদ নিখোঁজ হয়।
এ বিষয়ে ১০ মে পলাশবাড়ী থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন শিশুটির মা। একই দিনে প্রধান অভিযুক্ত প্রতিবেশী সাইফুল ইসলাম ওরফে শেরেকুলের ছেলে সাকিব হাসান ওরফে রোমান (১৯) ও সোহবার হোসেনের ছেলে শরিফুল ইসলামকে (২০) গ্রেপ্তার করে পলাশবাড়ী থানা পুলিশ।
গ্রেফতারকৃত আসামিরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে সন্তোষজনক তথ্য না দেওয়ায় পুলিশ রিমান্ডের আবেদন করে। ১৪ মে আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ডে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদে রোমান ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। পরে ১৫ মে রোমান আদালতে নৃসংশ এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
ঘটনার মুল হত্যাকারী রোমানের দাবি বায়েজিদের বোনের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। বর্তমানে মেয়েটি তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয় রোমান। এর জেরে সে মেয়েটির ছোট ভাই বায়েজিদকে হত্যার পরিকল্পনা করে। একপর্যায়ে সোমবার (৮ মে) বায়েজিদ নিখোঁজ হওয়ার দিনই তাকে হত্যা করে রোমান।
এ বিষয়ে পরে বিস্তারিত আরো জানানো হবে বলে জানায় পুলিশ।
ইতিপূর্বে শনিবার (১৩ মে) দিনগত রাত সাড়ে ৯টার দিকে উপজেলার মনোহরপুর ইউনিয়নের তালুক ঘোড়াবান্দা বালুখোলা গ্রামে নিজ বাড়ির উঠানে বিলাপ করে পুলিশ সুপারের সামনে বায়েজিদকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছিলেন শিশুটির মা রায়হানা বেগম।
তিনি সে সময় বলেন, প্রতিবেশী সূদের কারবারি সেরেকুলের ছেলে রোমান এলাকার একজন চিহ্নিত চোর। পাশাপাশি সে নেশায় আসক্ত। রোমানের পরিবারের পক্ষ থেকে তার মেয়ে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী তিশাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে আসছিল। কিন্তু এতে রাজি না হওয়ায় রোমান বিভিন্ন সময় হুমকি দেয়। এরই ধারাবাকিতকায় তার ছেলে বায়েজিদকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
নিহত শিশুর মা জানান, আমি চাই দোষিদের দৃষ্টান্তমুলক ফাঁসির দাবি । সেই সঙ্গে পুলিশ সুপারের কাছে স্থানীয় হরিণাবাড়ী পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-পরিদর্শক বুলবুল আহম্মেদের বিরুদ্ধ অসহযোগিতার অভিযোগ এনে তার শাস্তি কামনা করেন। পরে দায়িত্বে অবহেলার দায়ে এসআই বুলবুলকে হরিণাবাড়ী পুলিশ তদন্তকেন্দ্র থেকে গাইবান্ধা পুলিশ লাইন্সে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
পুলিশ সুপার আরো জানান, এ পর্যন্ত এ ঘটনায় গ্রেফতার আসামিরা হলেন- মো. সাকিব হাসান ওরফে রোমান (১৯), তার বাবা মো. সাইফুল ইসলাম ওরফে শেরেকুল, মা ববিতা বেগম, সাং-তালুক ঘোড়াবান্ধা (বালুখোলা), মো. শরিফুল ইসলাম (২০), তার বাবা মো. সোহরাব হোসেন (মেকার), মা শরিফা বেগম, সাং- তালুক ঘোড়াবান্ধা (মধ্যপাড়া) মো. খোরশেদ আলম (২১), তার বাবা মো. মজিবর রহমান, মো. আসাদুজ্জামান ওরফে রনি (১৯), তার বাবা মো. রাজা মিয়া, ছকিনা বেগম (৬০), তার স্বামী- মো. মজিবর রহমান, ববিতা বেগম (৪৫), স্বামী মো. সাইফুল ইসলাম ওরফে শেরেকুল মণ্ডল, মনিরা বেগম (২২), স্বামী মো. মোকছেদুর রহমান ওরফে বিদ্যুৎ, মো. রোস্তম আলী মণ্ডল (১৪), তার বাবা মো. সাইফুল ইসলাম ওরফে শেরেকুল মণ্ডল, মো. সোহাগ মণ্ডল (১৬), তার বাবা মো. শরিফুল ইসলাম মণ্ডল। এরা সবাই গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার তালুক ঘোড়াবান্ধা (বালুখোলা) গ্রামের বাসিন্দা।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন- জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অর্থ ও প্রশাসন) জনাব মো. ইবনে মিজান, পলাশবাড়ী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. মাসুদ রানা, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক (নি.) জনাব নুর-ই আলম সিদ্দীকি প্রমুখ।
প্রসঙ্গত: ৮ মে (সোমবার) বিকেল ৩টার দিকে বাড়ির পাশে খেলতে গিয়ে নিখোঁজ হয় উপজেলার মনোহরপুর ইউনিয়নের তালুক ঘোড়াবান্দা বালুখোলা গ্রামের সৌদি প্রবাসী তাহারুল ব্যাপারীর চার বছরের ছেলে বায়েজিদ।
পরদিন মঙ্গলবার (৯ মে) শিশুটির মা রায়হানা বেগম বায়েজিদের সন্ধানে পলাশবাড়ী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। চেষ্টা চালিয়েও শিশুটির কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না।
এরই ধারাবাহিকতায় শনিবার (১৩ মে) সন্ধ্যা ৬টার দিকে উপজেলার মনোহরপুর ইউনিয়নের তালুক ঘোড়াবান্দা বালুখোলা গ্রামের বিস্তীর্ণ একটি ধান ক্ষেত থেকে বায়েজিদের খণ্ডিত মরদেহ উদ্ধার করে পলাশবাড়ী থানা পুলিশ।
সেইদিন বিকেলে স্থানীয় দুইজন ব্যক্তি ধান ক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে দুর্গন্ধের সুত্রধরে শিশুটির অর্ধগলিত খণ্ডিত মরদেহ দেখতে পেয়ে পুলিশকে খবর দেয়। পরে ঘটনাস্থল থেকে মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য গাইবান্ধা জেলা হাসপাতাল মর্গে পাঠায় পুলিশ।
ঘটনার পরদিন (১৪ মে) সন্ধ্যার দিকে ময়নাতদন্ত শেষে বায়েজিদের মরদেহ তার গ্রামে এসে পৌঁছে। পরে নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে শিশুটিকে দাফন করা হয়।