পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর নিজস্ব উৎসব রয়েছে। কেননা, উৎসবের মাধ্যমে প্রাণের সজিবতা অক্ষুন্ন থাকে এবং মানুষ খুঁজে পায় জীবন সাধনার সিদ্ধি। আর মুসলমানদের জাতীয় উৎসব হলো ঈদ। ঈদ মানে খুশির বার্তা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা, বছরে এ দুটি ঈদে মুসলমানদের ঘরে ঘরে নিয়ে আসে অফুরন্ত আনন্দ। ছোট-বড়, ধনী -গরিব, সবার প্রাণে অনাবিল আনন্দের জোয়ার আসে। এই ঈদ উৎসবের মূল বাণী মানুষের ভালোবাসা, সম্প্রীতি, সকলের মাঝে একতা, সহানুভূতি ও ঐক্য। এতে মনে প্রানে যে আনন্দ জাগে সে আনন্দ শুধু ভোগের নয়, ত্যাগের। যে যত বেশি ত্যাগ করতে পারে সে তত বেশি আনন্দ পায়।
কুরবানির হুকুমঃ
কুরবানীর হুকুম কী? ওয়াজিব না সুন্নত? এবিষয়ে ইমাম ও ফকীহদের মাঝে মত পার্থক্য রয়েছে এবং তাদের দুটো মত রয়েছে।
১. প্রথম মতঃ কুরবানী ওয়াজিব।
ইমাম আওযায়ী, ইমাম লাইস,ইমাম আবু হানিফা রহ. প্রমুখের মত এটাই। আর
ইমাম মালেক ও ইমাম আহমদ রহ. থেকে একটি মত বর্ণিত আছে যে, তারা ওয়াজিব বলেছেন এ মতের দলিলঃ
আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ দিয়েছেন :فصل لربك و انحر
“তোমার রবের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং ( পশু)কুরবানী কর।” [ সুরা কাউসার :২] আর আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নির্দেশ পালন করা ওয়াজিব।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
من وجد سعة ولم يضح، فلا يقر بن مصلانا
“যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারে না আসে “। [ ইবনে মাজাহ:৩৫১৬
২]
২.দ্বিতীয় মত :ইমাম মালেক ও শাফি রহমাতুল্লাহ আলাইহি এর মতে কুরবানি সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। কিন্ত এই মতের প্রবক্তারা আবার বলেছেন সামর্থ্য থাকা অবস্থায় কুরবানী পরিত্যাগ করা মাকরুহ। এ মতের দলিল হচ্ছে :
রাসূল স. বলেছেন:
اذا راءيتم هلال ذي الحجة، واءر اد احدكم ان اءيضحي ، فليمسك عن شعره واءظفاره،
حتى يضحي.
” তোমাদের মাঝে যে কুরবানী করতে চায়, যিলহজ্ব মাসের চাঁদ দেখার পর সে যেন কোরবানি সম্পন্ন করার আগে তার কোন চুল ও নখ না কাটে”। [ সহীহ মুসলিম, ১৯৭৭] এই হাদীসে ‘যে কুরবানি করতে চায়’ কথা দ্বারা বুঝে আসে এটা ওয়াজিব নয় ; বরং সুন্নত ।
মোট কথা হলো,এ সকল দলীল- প্রমাণ পরস্পর বিরোধী নয় বরং একটা অন্যটার সম্পূরক। যারা কুরবানিকে ওয়াজিব বলেছেন তাদের প্রমাণাদি অধিকতর শক্তিশালী। আর ইবনে তাইমিয়া, মুহাম্মদ বিন সালেহ আলউসাইমিনের ও মত এটাই।
যার উপর কুরবানি ওয়াজিব :
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এরশাদ করেছেন –
من وجد سعة ولم يضح، فلا يقر بن مصلانا
সমর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানি করবে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে। (ইবনে মাজা ৩৫১৬২,মুসনাদে আহমাদ)
– হজ্জ পালনকারীদের জন্য কুরবানি ওয়াজিব।
– যার উপর সাদকায়ে ফিতর ওয়াজিব তার উপর কুরবানী ও ওয়াজিব।
– মুকিম হতে হবে অর্থাৎ নিজ বাড়িতে থাকতে হবে সফরে নয়।
– জমির মূল্য নিসাবের মধ্যে শামিল নয় কিন্তু তার ফসল যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত থাকে ও তার মূল্য নিসাব পরিমাণ হয় তাহলে তার ওপর কুরবানি ওয়াজিব হবে। ( শামী৫/১৯৮)
– নিসাব পূর্ণ হওয়ার জন্য স্বর্ণ-রৌপ্যের পৃথকভাবে হওয়া জরুরি নয় বরং দুটি মিলে অথবা এদের অলংকারাদির ওজন যদি সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্যের সমান হয় তাহলে তার উপর কুরবানি ওয়াজিব হবে ( শামী৫/১৯৮)
– স্ত্রীলোকের নিজস্ব মাল বা গহনাদি যদি নিসাব পরিমাণ থাকে তবে তার উপর কুরবানি ওয়াজিব। (শামী ৫/১৯৮)
– কুরবানী শুধু নিজের পক্ষ থেকে ওয়াজিব হয়,স্ত্রী ও বড় ছেলে মেয়ের পক্ষ থেকে ওয়াজিব হয় না।
– যদি নিছাবের মালিক নিজের নামে কুরবানি না করে অন্যের নামে অর্থাৎ বাবা-মা, ভাই-বোন, দাদা-দাদী, আত্মীয়-স্বজন, পীর, নেতা- নেত্রী ও মৃত ব্যক্তির নামে কুরবানী করে তাহলে জিম্মায় ওয়াজিব বাকি থাকবে । ( হিন্দিয়া ৬/১৯৫)
– যদি কোন মহিলার উসুলকৃত মোহর নিসাব পরিমাণ হয় তাহলে তার উপর কুরবানি আজিব । ( হিন্দিয়া৬/১৮৭)
– কোন কোন স্থানে মানুষ এক বছর নিজের নামে, এক বছর স্ত্রীর নামে, এক বছর ছেলের নামে অর্থাৎ প্রতিবছর নাম পরিবর্তন করে কুরবানি দেয়, এটা জায়েজ নয়। বরং যার উপর কুরবানি ওয়াজিব হয় শুধু তারই নামে কুরবানী করা ওয়াজিব। নচেৎ কুরবানি আদায় হবে না। তবে সকলে নিসাবের মালিক হলে সকলকেই পৃথক পৃথক কুরবানী করা ওয়াজিব । ( হিন্দিয়া ৬/১৯৫)
– দশই জিলহজ হতে বার ই জিলহজের সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কোন ব্যক্তি যদি মালিকে নিছাব অর্থাৎ নিসাব পরিমাণ মালের অধিকারী হয় তবে তার উপর কুরবানি করা ওয়াজিব। তবে ঋণী ব্যক্তির উপর কুরবানি ওয়াজিব নয়, কারণ ঋণ পরিশোধ করাই তার কর্তব্য। ঋণী ব্যক্তির কুরবানী করার অর্থ ফরজ নামাজ না পড়ে নফল নামাজ পড়ার জন্য ব্যস্ত হওয়া যার কোন প্রয়োজন নেই।
– একান্নভুক্ত পরিবারে পিতা জীবিত থাকলে শুধু পিতার উপর কুরবানি ওয়াজিব আর যদি ছেলেরা নিসাব পরিমাণ মালের অধিকারী হয় এবং প্রাপ্তবয়স্ক হয় তাহলে তাদের পৃথকভাবে কুরবানি দিতে হবে পিতার উপর তাদের কুরবানি ওয়াজিব নয়। (শামী৫/২০০)
– কেহ ১০ ও ১১ তারিখে সফরে ছিল, ১২ তারিখে সূর্যাস্তের পূর্বে বাড়ি এসেছে বা মালদার হয়েছেন বা কোথাও ১৫ দিন থাকার নিয়ত করেছে এরূপ অবস্থায় তার উপর কুরবানি ওয়াজিব হবে।
মোটকথা, কুরবানি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে এক বিশেষ অনুগ্রহ। কেননা বান্দাহ কুরবানির মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হতে পারে।
কুরবান শব্দটি কুরবুন শব্দ থেকে উৎকলিত। অর্থাৎ নিকটবর্তী হওয়া, সান্নিধ্য লাভ করা।আল্লাহ যেন আমাদেরকে এই কুরবানির মত বিশেষ ইবাদতের মাধ্যমে তার নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নেন আমিন।
লেখক: মাও. সাইফুল ইসলাম ফুয়াদ (আরবি প্রভাষক ও ইসলামি গবেষক)।