বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জুলাই গণহত্যায় ১৩ আগস্ট পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশে শহীদ হয়েছেন ৮৭৫ জন মানুষ, যার মধ্যে কমপক্ষে ৪২২ জন বিএনপি’র রাজনীতির সাথে জড়িত। আজ রোববার বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি একথা জানান।
গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের পথযাত্রায় বিএনপির ভূমিকা, অবদান ও প্রত্যাশা নিয়ে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান ও সালাহউদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, আজ আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের জনগণকে বারবার ত্যাগ শিকার করতে হয়েছে, রক্ত দিতে হয়েছে। এ দেশের স্বাধীনতাকে যখনই গ্রাস করেছে স্বৈরতন্ত্র, প্রতিবার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছে বিএনপি। বাকশালের পর বহুদলীয় গণতন্ত্র ও স্বৈরশাসনের পর সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, দেশের মানুষের অধিকার ও মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, সেই ধারাবাহিকতায়, ১৬ বছরের স্বৈরাচারী দুঃশাসনকে চূর্ণ করে, গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের জনগণ আবারও মুক্তির স্বাদ পায়, গণতন্ত্রের পথ সুগম করে। অসংখ্য ব্যক্তি ও পরিবার রয়েছে, যাদের বছরের পর বছর ধরে ত্যাগের মহিমায় আমরা ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলাদেশ পেয়েছি। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘জুলাই গণহত্যায়’ ১৩ আগস্ট পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশে শহীদ হন ৮৭৫ জন মানুষ, যার মধ্যে কমপক্ষে ৪২২ জন বিএনপি’র রাজনীতির সাথে জড়িত। দেশ জুড়ে শহীদ হওয়া সকল শ্রেণী-পেশা-রাজনীতির মানুষগুলোর এ বিশাল অংশ যে বিএনপিরই নেতা-কর্মী এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং আমাদের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের অনিবার্য ফল।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, পোশাক শ্রমিক কিংবা রিক্সাচালক, পাবলিক কিংবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাম কিংবা ডান আদর্শের অনুসারী, সকল মত ও পথের রাজনৈতিক কিংবা অরাজনৈতিক ব্যক্তি হতাহতের পরিচয় যাই হোক না কেন, প্রতিটি প্রাণের মূল্য ও রক্তের মর্যাদা সমান। আর তাই, সমান গুরুত্বের সাথেই প্রণয়ন করতে হবে প্রতিটি হত্যাকান্ডের তালিকা ও নিশ্চিত করতে হবে সুবিচার। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের জন্য যে জাতীয় ঐকমতা আমরা দেখতে পাই, তা কিন্তু হঠাৎ করে গড়ে ওঠেনি। এটি মূলত অবৈধ সরকারের অত্যাচার-অবিচার, দুর্নীতি-দুঃশাসন, বঞ্চনা-অবজ্ঞা, এবং শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
তিনি বলেন, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে, গণআকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটেছে, গণঅভ্যুত্থানে সর্বশক্তি দিয়ে রাজপথে নেমে আসে বিএনপি এবং এর সকল অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন। আন্দোলনের কৃতিত্ব নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল নয়, বিএনপির উদ্দেশ্য ছিল সর্বস্তরের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের অংশগ্রহণে, গণঅভ্যুত্থানে সাংগঠনিকভাবে সর্বোচ্চ ভূমিকা রেখে, ফ্যাসিবাদের পতনের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। আর তাই, বিএনপি’র যে ৬০ লাখ সদস্যের নামে ফ্যাসিবাদের সময় মিথ্যা মামলা হয়েছে, তার সুবিশাল অংশ সাধারণ মানুষের পাশে থেকে, রাষ্ট্রযন্ত্রের যড়যন্ত্র ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঢাল হয়ে রুখে দাঁড়ায়। ফলে যার-যার অবস্থান থেকে জনগণের কাতারে নেমে আসে বিএনপি ও সমমনা সকল রাজনৈতিক দল, তথা গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তিসমূহ।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদকে নির্মমভাবে হত্যা করে পুলিশ। একই দিন চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক ওয়াসিম আকরামকেও হত্যা করা হয়। এ হত্যাকান্ডগুলোতে সমগ্র বাংলাদেশ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, বেগবান হয় আন্দোলন। বিএনপি মহাসচিব বলেন, বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করতে ১৬ বছর ধরে আওযামী লীগের বিচারবহির্ভূত হত্যা, গায়েবি মামলা, ও নৃশংস নিপীড়ন দেশের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এর ফলস্বরূপ জাতিসংঘসহ স্বীকৃত মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও ভিসা নীতির মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে চাপ বাড়ায়। তৃণমূলের স্পন্দন ও গণমানুষের নেতা তারেক রহমানের নেতৃত্বে, অবিরাম জুলুম-অবিচারের মাঝেও, বিএনপির নেতা-কর্মীরা মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে। সেই অভীষ্ট লক্ষ্যে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের অবদানে গড়ে ওঠা দীর্ঘদিনের ঐক্যকে ধারণ করে, গণতন্ত্রের পক্ষের সকল শক্তির বলিষ্ঠ ভূমিকায়, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটে। বাংলাদেশের জনগণের এ বিজয় শুধুই দেশের মালিকানা ফিরে পাওয়ার বিষয় নয়। বরং এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার প্রতিশ্রুতি, যা অসীম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত। তিনি বলেন, বিজয়ের পেছনে রয়েছে অসংখ্য নির্যাতিত মানুষের বেদনার অপ্রকাশিত ইতিহাস। গুম হওয়া ছেলের ফেরার প্রতীক্ষায় ব্যাথাতুর মায়ের ডাক, স্বামী হারানো বেদনাবিধুর স্ত্রীর অনন্ত আর্তনাদ, পঙ্গু বাবার জন্য সন্তানের হৃদয়বিদারক হাহাকার, আর কারাগারে বন্দী ভাইযের জন্য বোনের নীরব প্রার্থনা। তাঁদের সকলের ১৬ বছরের রক্ত, শ্রম ও অশ্রু দিযে; প্রতিটি পরিবারের ক্ষোভ, ক্রোধ ও অব্যক্ত বিস্ফোরণ বুকে ধারণ করে; চলমান ছিল শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই।
বিএনপি মহাসচিব সংবাদ সম্মেলনে জানান, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে তার দলের শহীদ হয়েছেন ৪২২ জন। এছাড়া ২০২৩ সাল পর্যন্ত শহীদ ১ হাজার ৫৫১ জন, গুম ৪২৩ জন (সকল রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ মিলিয়ে প্রায় ৭০০ জন), আসামি ৬০ লাখ, এবং মামলা দেড় লাখ। এসব কেবল বিএনপির ত্যাগের পরিসংখ্যানই নয়, বরং বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনের পথে দলটির অবিচল সংগ্রাম ও অবদানের প্রতিফলন। তিনি আরও বলেন, যারা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে যুক্ত ছিল সেই গণতান্ত্রিক প্রতিটি ব্যক্তি, দল, সংগঠন ও গোষ্ঠীকে সকলের আত্মত্যাগের যথাযথ স্বীকৃতি না দিলে, তা হবে ইতিহাসের প্রতি অবিচার। সকল শ্রেণী-পেশা-মতের মানুষের অংশগ্রহণকে সম্মান জানিয়ে, জনগণের লুন্ঠিত ভোটাধিকার ফিরিয়ে এনে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাই আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। সেই পথযাত্রায় ও রাষ্ট্র সংস্কারে, বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফা বাস্তবায়ন করে গড়ে তুলতে হবে একটি নিরাপদ ও মেধাভিত্তিক বাংলাদেশ, যেখানে প্রতিফলন ঘটবে জনগণের আকাঙ্খা ও প্রত্যাশার।