ভোলার চরফ্যাসন উপজেলার ঢালচর এলাকা থেকে ৪৮ কিঃ মিঃ দক্ষিণে সাগর মোহনায় ট্রলিং জাহাজের ধাক্কায় আবদুল্লাহপুর ইউনিয়নের কালাম খন্দকারের মালিকানাধীন “মা-সামসুন্নাহার” নামের একটি মাছ ধরার ট্রলার ডুবির ঘটনায় ২১ জেলে নিখোঁজ হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যায় ট্রলার মালিকের ভাই হাফেজ খন্দকারকে উদ্ধার করেছে স্থানীয় জেলেরা। পরে তাকে পটুয়াখালী জেলার মহিপুর এলাকায় নিয়ে যায়। একজন উদ্ধার হলেও এখনও নিখোঁজ ২০ জেলে। ৬২ ঘন্টা পরেও তাদের সন্ধান না পাওয়ায় পরিবারে চলছে শোকের মাতম। নিখোঁজদের এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া। মঙ্গলবার খোঁজ-খবর নিতে ট্রলার মালিক কামালের বাড়িতে গেলে নিখোঁজ দুই পরিবারের লোকজনদের সাথে দেখা মিলে। সরকারের কাছে তাদের দাবী, নিখোঁজদের সন্ধান করে জীবিত হোক বা মৃত হোক উদ্ধার করে তাদেরকে যেন নিখোঁজদের মুখটা একবার হলেও দেখায়। এদিকে উদ্ধার তৎপরতা নিয়ে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে নিখোঁজদের স্বজনরা। রোববার রাতে ডুবে যাওয়া কোস্টগার্ড ও স্বজনরা আলাদাভাবে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করলেও নিখোঁজদের কোন সন্ধান করতে পারেনি।
বুধবার দুপুরে চরফ্যাসন উপজেলার আবদুল্লাহপুর ইউনিয়নে উত্তর শিবা গ্রামে গিয়ে দেখা যায় এক করুন দৃশ্য। নিখোঁজ ফারুক হাওলাদারের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, মা-বোনদের কান্নার আহাজারী। যেন তাদের কান্নায় আকাশ ভাড়ী হয়ে যাচ্ছে। ফারুক হাওলাদারের স্ত্রী সেতারা বেগম বিলাপ করতে করতে বারবার মুর্চা যাচ্ছেন। চেতনা ফিরে পাওয়ার পর আবার শুরু করেন গগণ বিদারী আর্তনাদ। মায়ের পাশে বসে বিলাপ করতে থাকে ফারুকের শিশু কন্যা শাকিরা (১০) ও শাবনুর (৮)। মাকে সান্তানা দেয়ার চেস্টা করতে দেখা যায় বড় মেয়ে সায়েরাকে। ভাই নিখোঁজের খবরে চেতনা হারিয়ে ওই বাড়ির উঠানে পড়ে থাকতে দেখা যায় ফারুকের বৃদ্ধা বোন বকুল বেগমকে। তাকে সেবা শুশ্রƒসা করে সুস্থ করার কাজে ব্যস্ত বাড়ির অন্য স্বজনরা। অপরদিকে রোববার ট্রলার ডুবিতে অন্যদের সাথে তিনিও নিখোঁজ আছেন একই গ্রামের মো. জাবেদ। ট্রলার ডুবির কয়েক ঘন্টা আগে স্ত্রীর সাথে শেষ কথা বলেন জাবেদ। হাতের মেহেদী শুকানের আগেই স্বামী হারানোর আশঙ্কায় নির্বাক তরুনী রাশিদা ঘরের দরজায় বসে বসে স্বামীর অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। টানা ২দিন কানতে কানতে এখন কথা বলতে পারেন না তিনি। জাবেদের বাড়ি গিয়ে দেখা যায় পুত্রবধু রাশিদা নিয়ে জাবেদের বৃদ্ধা মা ফাতেমা বেগম বাড়ির উঠানে বসে বিলাপ করছেন। বৃদ্ধার ফাতেমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ছেলে জাবেদকে হারানোর আশঙ্কা তিনিও দিশেহারা। অনিশ্চত ভবিষ্যতের অপেক্ষায় নতুন পুত্রবধুকে নিয়ে করা বিলাপ থামছে না ফাতেমা বেগমের।
নিখোঁজ ২০ জনের মধ্যে ৭ জনের বাড়িই আবদুল্লাহপুর ইউনিয়নে। ফারুক হাওলাদার আর জাবেদের পরিবারের মতোই জসিম, খালেক, ইউসুফ, রফিক, মাকসুদের বাড়িতেই বিলাপ আর্তনাদ। নিখোঁজদের মধ্যে রসুলপুর ইউনিয়নের ৫ জন। তারা হলো শাহিন, দিন মোহাম্মদ, সুমন,নাগর মাঝি, মিজান। মানিকা ইউনিয়নে নিখোঁজ রয়েছে বাচ্চু মুন্সি, নুরে আলম, আলামিন, হারুন, নুরুল ইসলম। নীলকলম ইউনিয়নে ট্রলার মাঝি বাচ্চু ও আবুল বাশার ও দৌলতখানের ১ জন। সরেজমিনে গিয়ে যোগাযোগ করলে ক্ষুদ্ধ স্বজনরা অভিযোগ করেন, দুর্ঘটনার পরই বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনকে জানানো হলেও উদ্ধার তৎপরতায় সঠিকভাবে হয়নি। এমন দুর্ঘটার সাথে সাথে উদ্ধার কাজ শুরু করা না হলে কাউকেই জীবিত পাওয়ার সম্ভবনা থাকে না। কোস্টগার্ড দক্ষিণ জোনের স্টাফ অফিসার (অপারেসন্স) জানিয়েছেন, ঘটনার পর পরই কোস্টগার্ড উদ্ধার অভিযান শুরু করেছে। মঙ্গলবার সকালে চরফ্যাসন থেকে ২টি টিম ও চট্ট্রগ্রাম থেকে একটি জাহাজ অভিযান পরিচালনা করছে। অভিযান এখনও অব্যাহত আছে। এছাড়া স্থানীয়ভাবে শামছল মাঝি নিজ খরচে ২টি ফিসিং ট্রলার নিয়ে স্বজনদের খোঁজে দুর্ঘটনাস্থলে উদ্দেশ্যে ঢালিরহাট ঘাট থেকে ছেড়ে গেছে। নিখোঁজ জেলের স্বজনদের সমবেদনা জানাতে এসে আবদুল্লাহপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আল এমরান প্রিন্স উদ্ধার অভিযান জোরদার করার দাবি জানান। দুর্ঘটনার পর পর ৮ জন উদ্ধারের তথ্য প্রকাশ করলেও প্রকৃত পক্ষে ট্রলার মালিকের ভাই হাফেজ আহম্মদ জীবিত উদ্ধার হয়েছেন। পটুয়াখালীর মহিপুরের জেলেরা তাকে ভাসতে দেখে উদ্ধার করে মহিপুর নিয়ে যান। মঙ্গলবার সকালে তাকে আনতে পরিবারের লোকজন মহিপুর গেলেও গতকাল সন্ধ্যায় পর্যন্ত বাড়িতে এনে পৌছায় নি। ২১ জেলের মধ্যে একমাত্র জীবিত উদ্ধার হয়েছেন হাফেজ আহম্মদ। চরফ্যাসন উপজেলা নির্বাহী অফিসার আল নোমান জানান, কোস্টগার্ডের একাধিক টিম উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করছে। বিষয়টি তিনি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন।