মো: আরিফুর রহমান (সুজন):
অফিস ছুটির দিন বা অবসর সময়ে পরিবার নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন বাংলাদেশ রেলওয়ে যাদুঘর। আসুন জেনে নেই যাদুঘর সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য ও বাংলাদেশ রেলওয়ের ইতিহাস।
বাংলাদেশ রেলওয়ে জাদুঘর – Bangladesh Railway Museum – চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে অবস্থিত দেশের একমাত্র রেলওয়ে জাদুঘর। এছাড়াও এটি দেশের একমাত্র জাদুঘর,যেখানে শত বর্ষের পুরনো বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিবর্তন ও আধুনিকায়নের ইতিহাস সংরক্ষিত রয়েছে। জাদুঘরটি চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থানার অন্তর্গত আমবাগানে বাংলাদেশ রেলওয়ে আর ওয়াগন কারখানার উল্টো দিকে এই ভবনটি প্রায় ১২ একর পাহাড়ী এলাকা জুড়ে অবস্থিত। জাদুঘরের কাঠের তৈরি দোতলা বাংলোটি যা প্রায় ৪২০০ বর্গফুট এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। ১৫ নভেম্বর ২০০৩ সালে দেশের একমাত্র রেলওয়ে জাদুঘরে পরিণত হবার পূর্ব পর্যন্ত এটি রেলওয়ের বাংলো হিসেবে ব্যবহৃত হত। ২০১৬ সালে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জাদুঘরটির সংস্কার কাজ শুরু করে।
জাদুঘরে বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্ববর্তী সংস্থা আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে “১৯৪২” ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে “১৯৪৭” এবং পাকিস্তান রেলওয়ে “১৯৬১” কর্তৃক ব্যবহৃত বিভিন্ন নিদর্শন এবং বস্তুর সমৃদ্ধ সংগ্রহ রয়েছে। সংরক্ষিত শিল্পকর্মগুলি প্রধানত বাংলাদেশ রেলওয়ের যান্ত্রিক,বৈদ্যুতিক,টেলিযোগাযোগ,সংকেত,
ট্রাফিক ও প্রকৌশল বিভাগের অন্তর্গত। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের বাতি ও আলো,পাকা ও ঘণ্টা,স্টেশন মাস্টারের পোশাক এবং আনুষঙ্গিক,সিগন্যাল সরঞ্জাম,
ট্রান্সমিটার,অ্যানালগ টেলিফোন,মনোগ্রাম,ট্র্যাক সুইচ এবং রেলওয়ে স্লিপার রয়েছে জাদুঘরের সংরক্ষণে।
ইতিহাস ও দৃষ্টিনন্দন নির্মাণ-শৈলীর এক যুগল বন্ধন যেন এই কাঠের বাংলোটি! দক্ষিণমুখী এক ব্যতিক্রমী নকশার কাঠের বাংলোয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এই জাদুঘর। জাদুঘরের মূল গ্যালারিতে ঢুকতেই ফটকের ওপর ড্রাগন খোঁদিত কাঠের গেটে ইংরেজি হরফে লেখা আছে বাংলোর নির্মাণকাল। ১৮৯৪ সালে এ বাংলো নির্মাণ করা হয়। ধারণা করা হয়,এখানে রেলওয়ে ভবনগুলোর মধ্যে এটাই সবচেয়ে পুরানো। এই দ্বিতল ভবনটির চারপাশের পরিবেশও অত্যন্ত আকর্ষণীয়।
রেলওয়ে জাদুঘরে রেলের যন্ত্রপাতি ৪ ভাগে ভাগ করে রাখা হয়েছে। চারটি বিভাগে যন্ত্রপাতি সংরক্ষণ করা হয়েছে। তার মধ্যে বাম দিকের গ্যালারিতে আছে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে “এবিআর” ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে,ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে ও বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভিন্ন মনোগ্রাম। একই সাথে রোলিং স্টকে ব্যবহৃত কালার শেড,ইঞ্জিনের বিভিন্ন নিরাপত্তা ও প্রতিরোধক ডিভাইস,ওভার স্পিড ট্রিপ ডিভাইস গভর্নর,ইঞ্জিন গভর্নর ইত্যাদি।
রেলের বিভিন্ন যন্ত্রপাতির মধ্যে ফুট প্যাডেল,ডেডম্যান লোকোমোটিভ সেফটি ডিভাইস,ডেডম্যান,এলার্ম বেল স্পিডোমিটার,ডেডম্যানলিলিপুট ডায়নামো,বিভিন্ন ধরনের ল্যাম্প যেমন- রিনিং ল্যাম্প,ঝাড়বাতি,ফ্যান্সি লাইট,গেইট ল্যাম্প,টেবিল ল্যাম্প,টেইল ল্যাম্প,সাইড ল্যাম্প,হ্যান্ডমিনাল ল্যাম্প। সংরক্ষণ করা হয়েছে রেলওয়ে গার্ডদের লুপস্টিক,ডেটিং মেশিন,পিতলের ব্যাজ,স্টেশন মাস্টার ক্যাপ,গার্ডবোট,উভেন পার,বক কংক্রিট পার,হ্যামার,রেলগেজ এমজি,বারক্রো,বারক্রো সুইং,বোর্ড লেবেল,বিভিন্ন পিচ পেট,বারকো পেইন রাউন্ড,স্পেশাল বিটার,হ্যামার,হ্যান্ড সিগনাল ফ্ল্যাগ,
ফ্লেকসো মিটার,রক ব্যালাস্ট ইত্যাদি।
পয়েন্ট টাইমিং মিটার,মোর্স কি উইথ সাউন্ডার,আর্ক লিভার,কন্ট্রোল কি,কি বক্স,সিগনাল আর্ম,টুলবক্স,
টেবলেট,কয়েকধরনের সিগনাল রিভার্সার,পয়েন্ট মেশিন,বিভিন্ন ধরনের এনালগ টেলিফোন,রোডল টেলিফোন,রেডিও ট্রান্সমিটার,রেডিও রিসিভার ইত্যাদি সংকেত বিভাগে সংরক্ষিত যন্ত্রপাতি।
প্রকৌশল ও ট্রাফিক বিভাগে আছে – ভেনসোমিটার,
থার্মোমিটার,মেজারিং ক্যান,স্প্যানার সিঙ্গেল,অ্যাডেড বারটমি,মনোরেল হুইল বোরো প্যাকিং লেভেল,প্যান পুলার,ক্যান-এ-বাউল ইত্যাদি।
এখানে চিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে অবিভক্ত বাংলায় প্রথম রেল লাইন স্থাপনের দৃশ্য। এখানে সংরক্ষিত আছে ১৯৪২ সালের ইস্টার্ন বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে ও বেঙ্গল আসাম রেলওয়ের মনোগ্রাম। আছে ১৯৭২ সালের স্বাধীন বাংলাদেশ এর প্রথম রেলওয়ে মনোগ্রাম। আরও রয়েছে ১৯৬০-৭০ইং পর্যন্ত ব্যবহার্য বিভিন্ন এনালগ ফোন এবং টেলিযোগাযোগ বিভাগের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি।
আরও রয়েছে ১৯৪৮ সালে ব্যবহার করা গার্ড কন্ট্রোল সুইচ,ফেলি লাইট,ইলেক্ট্রো হাইড্রলিক ১৯৮০ সালের পূর্বে ব্যবহার্য ঝাড়বাতি,রোলিং স্টকে ব্যবহৃত বিভিন্ন কালার কোড। এখানে ঐতিহাসিক নিদর্শনের মধ্যে আছে ১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক তথ্য। ৩০ মে রাতে সেনা অভ্যূত্থান ঘটানোর আগে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল সব ধরনের টেলি যোগাযোগ ব্যবস্থা। তখন রেলওয়ের রেডিও ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে এই খবর ঢাকায় প্রেরণ করা হয়। যে রেডিও ট্রান্সমিটারের সাহায্যে এই খবর প্রেরণ করা হয়েছিল তাও এ জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম রেলওয়ে জাদুঘর সমগ্র বাংলাদেশ রেলের প্রায় দেড়শ বছরের ইতিহাস,কৃষ্টির ধারক ও বাহক। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এই জাদুঘরটি হয়ে উঠতে পারে ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধ্রুবতারা। এই জাদুঘরের সংরক্ষণ শুধু যে রেলকে সমৃদ্ধ করবে তা-ই নয় প্রকৃতপক্ষে এটি চট্টগ্রামের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে জাদুঘরটি শুক্রবার বন্ধ থাকে। দর্শনার্থীদের জন্য শনিবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
(তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া / দ্যা ডেইলি স্টার)