৭-১০ দিনের ভেতর করোনাভাইরাস প্রতিরোধী বুস্টার ডোজ শুরু হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। শনিবার (১১ ডিসেম্বর) ঢাকা শিশু হাসপাতালে জাতীয় ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইন-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। মন্ত্রী জানান, তারা জাতীয় পরামর্শক কমিটির সুপারিশের অপেক্ষায় রয়েছেন। সেইসঙ্গে সুরক্ষা অ্যাপ আপডেটের কাজও চলছে। অথচ এক মাস আগেই তিনি বলেছিলেন, বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী টিকা পেলেই বুস্টার নিয়ে আলোচনা হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বয়স্কদের বুস্টার ডোজ দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরাও বয়স্কদের বুস্টার ডোজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ফ্রন্টলাইনারদেরও বুস্টার ডোজ দেবো। এর আগে গত ৩০ নভেম্বর সচিবালয়ে ওমিক্রন নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় ষাটোর্ধ্বদের বুস্টার ডোজ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন তিনি।
সেদিন তিনি বলেছিলেন, দেশের ষাটোর্ধ ব্যক্তি ও যাদের কো-মর্বিডিটি আছে তাদের বুস্টার ডোজ দেওয়া হবে। এর কার্যক্রম শুরুর জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরকে ইতোমধ্যেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
গত ১৫ নভেম্বর রাজধানীর মহাখালী বিসিপিএস মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিককের প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, দেশের বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীকে টিকা দেওয়ার পর বুস্টার ডোজের বিষয়ে আলোচনা হবে।
এদিকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ এখনও বুস্টার ডোজের পর্যায়ে আসেনি। দেশের মাত্র কয়েক শতাংশ রোগী টিকার আওতায় এসেছেন। বুস্টার ডোজের চিন্তা এখন পুরোপুরি অযৌক্তিক। এটি দেওয়া হলে টিকাদান কর্মসূচিতে অসমতা আসবে।
তারা আরও বলছেন, লক্ষ্যমাত্রার ৮০ শতাংশ পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত বুস্টার ডোজের সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।
টিকার তৃতীয় ডোজই হলো বুস্টার। বলা হচ্ছে, এই ডোজ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেবে। গত ২১ অক্টোবর সিনোভ্যাক টিকা গ্রহণকারী ষাটোর্ধ্বদের বুস্টার ডোজ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থাটি বলছে, যারা বেশি ঝুঁকিতে আছেন, তাদের বুস্টার ডোজ নিয়ে ভাবতে হবে।
বাংলাদেশে দুই ডোজ করে মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ১৩ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০৮ জনকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে দেশে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়। ৭ ফেব্রুয়ারি টিকাদান কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ১০ কোটি ৮২ লাখ ৩০ হাজার ৭১৯ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে।
এরমধ্যে প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে ছয় কোটি ৬২ লাখ ৮৭ হাজার ৩৯৬ জনেক আর দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন চার কোটি ২০ লাখ ৪৩ হাজার ৩২৩ জন। প্রথম ডোজ পেয়েছেন ৩৯ দশমিক দুই আর দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ২৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ। দেশে অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার, মডার্না ও চীনের সিনোফার্মের টিকা দেওয়া হচ্ছে।
বুস্টার ডোজ দেওয়ার প্রয়োজন কতটুকু জানতে চাইলে টিকা বিষয়ক ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজরি গ্রুপ নাইট্যাগ-এর সদস্য অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘আমরা এ নিয়ে আলোচনা করেছি। বুস্টার ডোজ দেওয়ার কোনও যুক্তি নেই।’
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘মাত্র ২৪ শতাংশের কিছু বেশি মানুষকে দুই ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা হলো ৮০ ভাগ। এখনও দেশের ৫৫ শতাংশ মানুষকে দুই ডোজ টিকা দিতে পারিনি। সেক্ষেত্রে বুস্টার ডোজ দিতে চাই কোন যুক্তিতে?’
তিনি বলেন, ‘বুস্টার ডোজ দেওয়া হলে কিছু মানুষ বঞ্চিত হবে।’ এ ডোজ দেওয়া হলেও তাতে বিশেষ লাভ হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটার চিন্তা করা হচ্ছে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের কারণে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে বুস্টার ডোজ আদৌ কাজে আসবে কিনা সেটা আগে নিশ্চিত হতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ওমিক্রনে এখনও মৃত্যু নেই। কিন্তু ইউরোপসহ অন্য অনেক দেশে এখনও ডেল্টায় আক্রান্ত হচ্ছে, মৃত্যু হচ্ছে। চলতি বছরে দেখা গেছে, মার্চ-এপ্রিলে সংক্রমণের হার অনেক বেড়ে যায়। আগামী মার্চেও সংক্রমণ বাড়তে পারে। এমনটা যদি ভাবি, তবে আমাদের প্রটেকশন কোথায়?’
ডা. বেনজির বলেন, ‘৫৫ শতাংশ মানুষ এখনও অরক্ষিত। এর ২০ ভাগও যদি আক্রান্ত হয়, তবে আরও লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত হবে। সিভিয়ারিটি বাড়তে পারে। মৃত্যু হতে পারে।’
বিশ্বে বুস্টার ডোজের যে টিকা দেওয়া হচ্ছে, সেটা মূলত মডার্না ও ফাইজারের ক্ষেত্রে। সেটাতো বাংলাদেশে বেশি দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশে বেশি দেওয়া হয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও চীনের টিকা। অ্যাস্ট্রাজেনেকার বেলায় গবেষণায় বলা হচ্ছে, দুই ডোজ দেওয়া হলে এটা লাইফ-লং ইমিউনিটি দেবে। এক্ষেত্রেও বুস্টারের দরকার নেই।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক আপনাদের মতামতের অপেক্ষায় রয়েছেন বলে জানালে তিনি বলেন, ‘আমরা তো মতামতে এসেছি। বুস্টার ডোজ দেওয়ার সময় আসেনি।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, “এখন পর্যন্ত ২৪ শতাংশের বেশি মানুষকে আমরা টিকা দিতে পারিনি। এ অবস্থায় বুস্টার ডোজকে আমি বলবো ‘রোমান্টিক’ কথা।”
আগে রেগুলার টিকাটা দেওয়া দরকার জানিয়ে ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, নয়তো কোনোভাবেই সমতা আসবে না।