স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘যুবসমাজকে মাদক থেকে সরিয়ে আনতে বিকল্প ব্যবস্থা অবশ্যই দরকার। তবে আমাদের বুঝতে হবে ক্ষতিকর ড্রাগ কোনটা? এলএসডি, ইয়াবা, হেরোইন এগুলো ক্ষতিকর বিধায় যারা সেবন করে, তাদের ব্রেন ও লিভার দুই বছরের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। তাই এগুলো থেকে যুবসমাজকে সরানোর উপায় খুঁজে বের করার বিকল্প কী আছে, তা নিয়েও সরকার কাজ করছে।’
দেশে ইয়াবা, এলএসডি, আইস, ফেন্সিডিল, হিরোইনের মতো মাদকের হাত থেকে তরুণ ও যুবকদের মনোযোগ সরাতে মদ ও গাঁজায় ছাড় দিতে আলোচনা করেছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
তাদের দাবি, অ্যালকোহলের ওপর কিছুটা ছাড় দিলে মাদক সেবন কমতে পারে। একই সঙ্গে গাঁজা সম্পর্কেও আরও চিন্তাভাবনা করা উচিত বলে মত উঠে এসেছে এই আলোচনায়। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির এক বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা এসব কথা বলেছেন।
এর আগে ৭ নভেম্বর সংসদীয় কমিটির বৈঠকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনা হয়। বৃহস্পতিবার সংসদীয় কমিটির বৈঠকে ওই আলোচনার কার্যবিবরণী অনুমোদন হয়। দেশে অ্যালকোহল আমদানির শুল্ক ৬০০ শতাংশ। ফলে বিদেশি মদ আনতে দেশের ক্লাবগুলোর আমদানির লাইসেন্স থাকলেও তারা সেটি না করে চোরাই পথে আসা মদ বিক্রি করে। তবে ওই বৈঠকে মদ উন্মুক্ত করা বা এ বিষয়ে ছাড় দেয়ার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
সংসদীয় কমিটি বলেছে, অ্যালকোহল উন্মুক্ত করার বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। অ্যালকোহল আমদানিতে কর কমানোর বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মত নেয়া যেতে পারে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বৈঠকে জানিয়েছিলেন, এলএসডি, ইয়াবা, হেরোইনের মতো ক্ষতিকর মাদক থেকে যুবসমাজকে সরানোর উপায় খুঁজে বের করার বিকল্প কী আছে, সেটি নিয়ে সরকার কাজ করছে।
ওই বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দীন বলেন, ‘ড্রাগ এবং অ্যালকোহল দুটি ভিন্ন জিনিস। অ্যালকোহলের প্রতি কিছুটা ছাড় দিলে ড্রাগ সেবন কিছুটা কমতে পারে। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট মতামত ও নির্দেশনা প্রয়োজন।’
পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘দেশে অ্যালকোহলের ওপর ৬০০ শতাংশ কর নির্ধারণ করা আছে। দেশের সব ক্লাবে অ্যালকোহলের লাইসেন্স আছে। কিন্তু তারা কেউ আমদানি করে না। কারণ, ট্যাক্স দিতে হয় বেশি। ক্লাবগুলো বেআইনিভাবে চোরাই পথে আসা মদ বিক্রি করে, যার কারণে দাম কম, ক্রেতা বেশি। এতে করে সরকার প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার ট্যাক্স থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাহলে মদ আমদানির ওপর ট্যাক্স বৃদ্ধি করে কী লাভ হলো?’
ট্যাক্স কমিয়ে দিলে অথবা মদ উন্মুক্ত করে দিলে ইসলামপন্থি বিভিন্ন দল আন্দোলনে নেমে যাবে বলেও মন্তব্য করেন পুলিশ প্রধান। বৈঠকে বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম বলেন, ‘মাদক নির্মূল করতে হলে কিছু নীতি পরিবর্তন করতে হবে। চোরাই পথে আসা মদ ও বিয়ার ঢাকার সব ক্লাবে বিক্রি হয়। ক্লাবগুলোর বৈধ লাইসেন্স রয়েছে আমদানি ও বিক্রির। তিনি বলেন, ‘ট্যাক্স দিয়ে কেউ আমদানি করে না। মুসলিম দেশ হিসেবে উন্মুক্তভাবে না হলেও কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দিলে যুবসমাজের মাদকাসক্তি কমিয়ে আনা যাবে।’
বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, ‘ফেনসিডিল, ইয়াবা বন্ধে সীমান্ত এলাকায় অনেক পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। এরপরেও ঠেকানো যাচ্ছে না। এ কারণে নতুন পরিকল্পনা নেয়া উচিত। সংসদীয় কমিটির ওই বৈঠকে র্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আমেরিকা ও কানাডা গাঁজা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। বাংলাদেশের মাদক কখনও বন্ধ করা যাবে না। তবে হয়তো কিছুদিনের জন্য কমিয়ে আনা যেতে পারে। কারণ মাদকের বিকল্প কিছু একটা সামনে নিয়ে আসতে হবে। তাই অ্যালকোহল, মদ, গাঁজা এগুলো সম্পর্কে আরও চিন্তাভাবনা করা উচিত।’
ওই বৈঠকে কমিটির সদস্য জাতীয় পার্টির সাংসদ পীর ফজলুর রহমান বলেন, ‘মদ, বিয়ার বা অ্যালকোহলের ওপর ট্যাক্স কমিয়ে দিয়ে যদি রাজস্ব বৃদ্ধি পায়, তাহলে তাই করা উচিত। ড্রাগ অর্থাৎ আইস, ইয়াবা, এলএসডি এগুলো ভয়াবহ ক্ষতিকর মাদক। কোনো মাদকে অ্যালকোহলের পরিমাণ পাঁচ শতাংশের নিচে থাকলে তা সরকারিভাবে বৈধ করা আছে। মদ, বিয়ার ইত্যাদিতে যদি পাঁচ শতাংশের নিচে অ্যালকোহল থাকে, তাহলে এগুলো বৈধ ঘোষণা করে দেওয়া উচিত। গিয়ার নামে ড্রিংকস চার দশমিক নয় শতাংশ দিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে।’
যুবসমাজকে মাদকের নেশা থেকে বাঁচাতে এসব বিবেচনা করার জন্য সরকারের কাছে তিনি অনুরোধ করেন। সংরক্ষিত আসনের বেগম রুমানা আলী বলেন, ‘যেসব মাদক হালকা ক্ষতিকর, সেগুলো ব্যবহার উন্মুক্ত করা যেতে পারে। যেগুলো দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে ক্ষতি হয়, সেগুলোকে অনুমোদন দেওয়া উচিত নয়। কর্মকর্তাদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বৈঠকে বলেন, ‘যুবসমাজকে মাদক থেকে সরিয়ে আনতে বিকল্প ব্যবস্থা অবশ্যই দরকার। তবে আমাদের বুঝতে হবে ক্ষতিকর ড্রাগ কোনটা? এলএসডি, ইয়াবা, হেরোইন এগুলো ক্ষতিকর বিধায় যারা সেবন করে, তাদের ব্রেন ও লিভার দুই বছরের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। ‘তাই এগুলো থেকে যুবসমাজকে সরানোর উপায় খুঁজে বের করার বিকল্প কী আছে, তা নিয়েও সরকার কাজ করছে। যমুনা গ্রুপের হান্টার ড্রিংকস ৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ ঘোষণা দিয়ে পণ্য বাজারজাত করছে। সব বিষয়ের ওপর সরকার সার্বিক বিবেচনা করেই পদক্ষেপ নেবে।
ওই আলোচনার শেষ পর্যায়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি শামসুল হক বলেন, ‘অ্যালকোহল সেবন উন্মুক্ত করার বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। অ্যালকোহল আমদানিতে ট্যাক্স কমানোর বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মত নেয়া যায়। একই সঙ্গে চোরাইপথে বা অবৈধ পথে আমদানি হলে লাইসেন্স বাতিলসহ আমদানিকারকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। তিনি বলেন, ‘অ্যালকোহল কী পরিমাণ মাত্রায় সেবন করা যায়, তার জন্য বিভিন্ন নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞ রয়েছে। ড্রাগ অর্থাৎ মাদক বলতে যেটা বোঝাচ্ছে সেটার কারণে দেশের তরুণসমাজ ধ্বংস হচ্ছে। যেসব মাদক সেবন করলে যুবসমাজ নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে যেমন ইয়াবা, এলএসডি, আইস, হেরোইন ইত্যাদি বন্ধ করার জন্য কঠোর হতে হবে। তরুণসমাজকে রক্ষা করার জন্য মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত থাকতে হবে।’
শামসুল হক আরও বলেন, ‘পুলিশের হাতে ইয়াবা ধরা পড়লে বিজিবির ওপর কিছুটা হলেও দায় এসে যায়। হয়তো কিছু চেকপয়েন্টে আরও সতর্ক হওয়া দরকার ছিল। তেমনি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আরও তৎপর থাকলে ইয়াবার প্রবেশ ঠেকানো যেত। সবগুলো সংস্থাকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। মাদকের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে না পারলে দায় সবার।