লেখক: এস.এম.আক্তারুজ্জামান, ডিআইজি বরিশাল রেঞ্জঃ
সরকারি অফিসগুলি লিখিত সরকারি আইন, বিধিমালা, নিয়ম অনুযায়ী চলে। অবশ্যই এর একজন কর্তা থাকে, যে লিখিত বিধানের বাহিরে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব এবং প্রদত্ত ক্ষমতাবলে কিছু আদেশ বা হুকুম দিতে পারে। কতটুকু দিবে বা দেয়া উচিত কিনা এটা আমার ভাবনা নয়, আমার ভাবনা কর্তার অস্তিত্ব নিয়ে।
কর্তাকে একজন ব্যাক্তি বা একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে পারি। আমাদের দেশে মানুষজন বা কর্তাগন নিজেদেরকে ব্যাক্তি হিসেবে প্রতিষ্টা করতে আনন্দ পায় বা তৈরি করে ফেলে যা বিধি সম্মত নয়। পুলিশের ক্ষেত্রে বলতে গেলে, পুলিশের মৌলিক ভিত্তি ইউনিট থানার প্রধান কর্তাকে বলে “ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা”। নামেই বুঝা যায় এটা কোন স্পেসিফিক ব্যক্তি নয়। এটা থানার সকল দায়িত্ব পালন করার জন্য নিযুক্ত যে কোন ব্যাক্তি হতে পারে। পুলিশের সর্বনিম্ন ধাপের কর্মকির্তা, কনস্টেবল এর উপরের সর্বোচ্চ পদের যে কর্মকর্তা থানার মধ্যে হাজির থাকবেন, তিনিই ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। অর্থাৎ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একটি ডায়নামিক প্রতিষ্ঠান। থানার জিডি বুকে এন্ট্রি দিয়ে দায়িত্ব বুঝে নেন, উনি অনুপস্থিত থাকলে যে সিনিয়র থাকবে সে তার কাছ থেকে থানার দায়িত্ব বুঝে নিবে জিডিতে নোট দিয়ে। বলা প্রয়োজন, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নামে কোন পদ থানায় সৃজন করা হয়না। হয় পুলিশ পরিদর্শক হিসেবে।
একই ভাবে, তবে ভিন্ন ধাচে এসপি অফিসে এসপি পদটিও একটি ব্যাক্তি এবং প্রতিষ্টান। কারন এসপি নামেই পদটি সৃজন হয়, তবে এসপি শুধু একজন ব্যাক্তি নয়, সাথে প্রতিষ্ঠান। এসপি অনুপস্থিত থাকতে পারে, তবে তার কাজ বা এসপি অফিসের কাজ কোন ক্রমেই ধীর, স্থগিত, বা অচল হবেনা, এসপি’কে ব্যাক্তি হিসেবে যে দায়িত্ব দেয়া থাকে তা ব্যাতীত। অনুরুপ ব্যাবস্থা ডিআইজি অফিসের খেত্রেও।
আমার ভাবনা এসবের পুথিগত বিদ্যা দেখানোর জন্য নয়, বরং প্রায়োগিক ভাবনা নিয়ে। অনেকেই ফোন করেন কর্তাদেরকে, জানতে চায় কখন কিভাবে উনাদেরকে পাওয়া যাবে অফিসে বা অন্য কোথায়। তারা সাক্ষাত চায় ফোনে সরাসরি বা অন্য কারও মাধ্যমে। এসব কাজ করেন কারা? এখানে শিখার এবং মাইন্ড করার অনেক কিছু আছে। যারা মনে করেন, কর্তারা ব্যাক্তি এবং তার ক্ষমতা দিয়ে তার কাজ হবে তারা, অথবা এমন কর্তারা যারা তাদের অফিসকে এমনভাবে সাজিয়ে তুলে যে তাকে ছাড়া কোন কাজ হবেনা। এই অফিস কালচারকে বলা যায় “ওয়ান মেন শো”। দুটাই বিধির বাহিরে।
সবচেয়ে মজার বিষয়, যারা সমাজের নীচে অবস্থান করেন, বা কর্তাদেরকে চিনেন না বা সরকারি নিয়ম কানুন জানেননা, যাদের ফোন করার উপায়, সাহস, মাধ্যম, অবস্থান কোনটাই নাই তারা সরাসরি অফিসে চলে আসেন কাজের জন্য। আর যাদের কোন একটা পরিচয় আছে বা মর্যাদা অর্জন করেছেন, তারা ফোন না দিয়ে কাজ করতে আসেন না। তারা সৌজন্য সাক্ষাতের নামে কাজের সুচনা করেন।
আমি ডিআইজি অফিসকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে আগ্রহী। আমি চাই, আমার অনুপস্থিতিতে এই অফিস বেটার চলবে। আমার জুনিয়ররা আমার চেয়ে বেশি দক্ষ, বিচক্ষন, মেধাবি, এবং আন্তরিক হবে। আমি চাই, আমার অফিসের ৯০% ভাগ কাজ চলবে মেশিনের মত সিস্টেমে, আর ১০% কাজ হবে ব্যাক্তির সিদ্ধান্তে। আমার সহকর্মীরা আমার মেসেজ জানেন এবং বুঝেন। তাই, আমি নিশ্চিন্তে বরিশাল ছেড়ে চলে যাচ্ছি সাভার, ৪৫ দিনের প্রশিক্ষনে। আপনারা বরিশাল ডিআইজি অফিসকে আগের মত বা এর চেয়ে উন্নত এবং দক্ষ ভাববেন। তবে, বরিশালের লোকজন খুব বুদ্ধিমান, সচেতন। তারা বুঝে নিয়েছেন আমাদের কথা। আমি জানি আপনারা আমাকে মিস করবেন না৷ তবে আমি আপনাদের মিস করব, মিস করব বরিশালের নীল আকাশ, সবুজ প্রানবন্ত পরিবেশ, লেভিশ আপ্যায়ন। মিস করব আমার সকল সহকর্মীদের যারা আমাকে অনেক ভালবাসেন, শ্রদ্ধা করেন। দোয়া রইলো সবার জন্য।