কলেজের ক্লাশরুম ব্যাংকের কাছে ভাড়া দিয়ে, শতবর্ষী মেহগনি গাছ বিক্রি করে, শিক্ষকদের নামে লোন নিয়ে এবং শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি-সহ বিভিন্ন খাত থেকে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ভোলার ইলিশা ইসলামিয়া মডেল কলেজের চাকরিচ্যুত সাবেক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এদিকে চাকরি হারিয়ে মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন ইলিশা ইসলামিয়া মডেল কলেজটি বন্ধ করে দেয়া এবং কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ক্ষতি করার পায়তারা চালিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি গত চার বছরে মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন মিথ্যা, ভুয়া ও মনগড়া অলিক অভিযোগ তুলে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে ১৮টি মামলা দায়ের করেছেন। এতে কলেজের প্রায় দেড় হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবনে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায়, ভোলা সদর উপজেলার ইলিশা জংশন বাজার এলাকায় ২০০৪ সালে ইলিশা ইসলামিয়া মডেল কলেজটি এমপিওভুক্ত হয়।
কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন শুরু থেকেই নানান অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে কলেজের লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাতে মেতে ওঠেন। কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকে চাকরি হারানো পর্যন্ত প্রায় ১৫ বছর বিনা রশিদে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে প্রায় চার কোটি টাকা আত্মসাত করেন। অধ্যক্ষ নিজাম উদ্দিন কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকে কোন রশিদ বই ছাপাননি। অভিযোগ রয়েছে নিজাম উদ্দিন বিভিন্ন সময়ে ম্যানেজিং কমিটি ও গভর্নিং বডির সভাপতিদের স্বাক্ষর জাল করে কলেজ ফান্ডের প্রায় দশ লক্ষাধিক টাকা আত্মসাত করেন। কলেজের শতবর্ষী ৪৮টি মেহগনি গাছ বিক্র করে প্রায় এক কোটি টাকা আত্মসাত করেন। কলেজের একমাত্র দ্বিতল ভবনটি অবৈধভাবে রূপালি ক্যাংকের কাছে ভাড়া দিয়ে অগ্রীম দুই লক্ষ এক হাজার ৬০০টাকাসহ প্রায় ৪ লক্ষাধিক টাকা আত্মসাৎ করেন। কলেজের জমিতে দোকানঘর উঠিয়ে ব্যাবসায়ীদের কাছে ভাড়া দিয়ে প্রায় ৬ লক্ষাধিক টাকা আত্মসাত করেন। কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য একটি মাইক্রোবাস কেনার কথা বলে শিক্ষকদের কাছ থেকে জোর করে চাদা উত্তোলন করে। কিন্তু মাইক্রোবাস ক্রয় না করে ওই টাকা আত্মসাত করেন।
কারিগরি শিক্ষার্থীদেরকে অভ্যন্তরিণ পরীক্ষায় ফেল দেখিয়ে পূণরায় ফরম ফিলাপ করতে বাধ্য করতেন। অথচ বোর্ডের রেজাল্টে ওই শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছিল। এভাবে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। আবার শিক্ষকদের নামে ব্যাংক লোন নিয়ে অর্ধকোটি টাকার বেশি আত্মসাত করেন। প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে এবং শিক্ষক কর্মচারীদের নামে ব্যাংক লোন নিয়ে টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মো: মাহফুজুর রহমান, জিনাত জাহান, মিঠুন দে, নেপাল বণিক, মো: ফারুক, রাবেয়া বেগম, হারুন অর রশিদ, সুলতানা রাজিয়া, শাহিনা বেগমসহ আরও কয়েকজন শিক্ষক কর্মচারীর কাছ থেকে প্রায় অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। প্রতারণার শিকার শিক্ষকদের দায়ের করা মামলায় তিনি প্রায় এক বছর জেল খাটেন। পাশাপাশি দায়িত্ব পালনে অনিয়ম এবং টাকা আত্মাসাতের বিষয়ে একাধিক তদন্ত কমিটির রিপোর্টের আলোকে তাকে প্রথমে ২০ আগস্ট ২০১৮ তারিখে সাময়িক এবং পরবর্তীতে ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখে তাকে চুড়ান্তভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়।
এদিকে বিভিন্ন তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ও বিভিন্ন অনুসন্ধানে উঠে আসে মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন নদীভাঙ্গা পরিবারের একজন সামান্য স্কুল শিক্ষকের ছেলে। কলেজে চাকরি ছাড়া তার বিকল্প কোন আয়ের উৎস ছিল না। অথচ আলাদীনের চেরাগ পাওয়ার মতই মাত্র ১৪/১৫ বছর চাকরি করে ঢাকার মিরপুর পল্লবিতে তিনটি ফ্লাট, গাবতলী ও সাভারে একাধিক প্লট, কেরানিগঞ্জে দুটি প্লট, ভোলা সদরের ইলিশা বাসস্টান্ডে একটি প্লট, বাপ্তা মহাজনের পোল এলাকায় ৪২ শতাংশ জমি, বাপ্তা বালুর মাঠ এলাকায় ৪০ শতাংশ, ইলিশা বাগার হাওলায় ৩৮ শতাংশ জমিতে পাকা ভবন, ইলিশার হাটে ২০ শতাংশ, ইলিশা দারোগার খাল এলাকায় ৬০ শতাংশসহ আরও বিভিন্ন স্থানে বিপুল পরিমাণ সম্পতির মালিক হয়েছেন। কলেজের শিক্ষকরা জানান, কলেজের একমাত্র দ্বিতল ভবনটিতে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেয়া হত। কিন্তু নিজাম উদ্দিন টাকার লোভে উক্ত কলেজ ভবন ব্যাংকের কাছে ভাড়া দিয়ে দেন এবং কলেজ ক্যাম্পাস থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে ইলিশা বাজারের টলঘরে এবং মুরগির খামারে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতে বাধ্য করেন। অথচ কলেজের কোন কাগজ পত্রে ব্যাংকের কাছে কলেজ ভবন ভাড়া দেয়ার তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি এবং নিজাম উদ্দিন বরখাস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত কলেজের ফান্ডে ব্যাংক কিংবা দোকানঘর ভাড়ার একটি টাকাও জমা দেয়া হয়নি।
কলেজের শিক্ষক কর্মচারীরা জানান, অধ্যক্ষ নিজাম উদ্দিন দায়িত্ব পালনের বেশিরভাগ সময়ই ভুয়া ম্যানেজিং কমিটি দিয়ে কলেজ ফান্ডের লাখ লাখ টাকা আত্মসাতসহ নানান অনিয়ম করেছিলেন। তার বেপরোয়া অন্যায় অনিয়মের দৌরাত্ম্যের কাছে শিক্ষক কর্মচারীরা জিম্মি হয়ে পড়েছিলেন। কারণ তিনি কলেজ পরিচালনা করতেন পকেট কমিটি দিয়ে। কমিটির সভাপতিসহ অন্যান্য সদস্যদের স্বাক্ষর তিনি নিজে দিয়ে নিতেন। কমিটিতে যাদের নাম ব্যবহার করা হত তারা জানতেনও না যে তাদেরকে ম্যানেজিং কমিটির সদস্য করা হয়েছে। তার দায়িত্ব আমলে কলেজে ম্যানেজিং কমিটির এবং গর্ভনিং বডির কোন মিটিং হতে দেখেনি কেউ। এত অনিয়মের পরও চাকরি হারানোর ভয়ে শিক্ষক কর্মচারীদের কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি।