পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বর্তমান প্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার মেয়াদ শেষ হয়ে এসেছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ২৯ নভেম্বর পাকিস্তানের রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থায় সবচেয়ে ক্ষমতাধর এই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তার পদ থেকে অবসরে যাবেন তিনি।
কিন্তু এই মুহূর্তে দেশটির রাজনীতিতে জেনারেল বাজওয়ার অবসরের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্নটি ঘুরপাক ঘাচ্ছে, তা হলো— কে হবেন বাজওয়ার উত্তরসূরী? অর্থাৎ পাকিস্তানের পরবর্তী সেনাপ্রধান হিসেবে আসবেন কোন সেনা কর্মকর্তা।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে হিসেবের মধ্যে আনলে এই প্রশ্নটিকে একান্তই অদ্ভুত, অভূতপূর্ব বলে মনে হবে।
কারণ ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তিলাভের মাত্র এক যুগের মধ্যেই গণতন্ত্রপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোকে পিছু হটতে বাধ্য করে কেন্দ্রীয় শাসনক্ষমতা দখল করে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। সাবেক প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার আলি মির্জা ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর এক অধ্যাদেশে তৎকালীন পাকিস্তান জুড়ে সামরিক শাসন জারি করেন, সেই সঙ্গে প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করেন জেনারেল আইয়ুব খানকে। তার মাত্র ২০ দিন পর, ২৭ অক্টোবর ইস্কান্দার মির্জাকে সরিয়ে নিজেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন আইয়ুব খান।
সেই থেকে দেশটির রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর অংশগ্রহণ শুরু। তারপর গত প্রায় ৬৫ বছর ধরে কখনও সরাসরি, কখনও বা আড়ালে থেকে সর্বদা পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। এই সময়সীমার মধ্যে যে কয়েকজন বেসামরিক রাজনীতিক পাকিস্তানের শাসনক্ষমতায় এসেছেন, তাদের প্রত্যেককেই সেনাবাহিনী ও আইএসআইয়ের মদত ও আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে আসতে হয়েছে; এবং যেসব রাজনীতিকের ওপর সেনাবাহিনী ও আইএসআই রুষ্ট হয়েছে, তাদেরকে রাজনীতি থেকে তো বটেই, অনেক সময় দেশ— এমনকি পৃথিবী থেকেও বিদায় নিতে হয়েছে।
সফল ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া ইমরান খানও পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর আশীর্বাদপুষ্ট হয়েই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হলেও ক্ষমতায় যেতে তাকে পূর্বসূরী রাজনীতিকদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হয়েছিল।
কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইমরান খানের দূরত্ব সৃষ্টি হয় এবং তার জেরেই চলতি বছর ১০ এপ্রিল পার্লামেন্টে বিরোধী দলীয় এমপিদের অনাস্থা ভোটে প্রধানমন্ত্রীর পদ হারান পাকিস্তান তেহরিক-ই ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান; ক্ষমতায় আসীন হয় সাবেক বিরোধী দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের (পিএমএলএন) নেতৃত্বাধীন জোট সরকার।
কিন্তু গত ৭ মাসে সেই দূরত্ব যে এখনও ঘোচেনি, বরং আরও বৃদ্ধি পেয়েছে—ইমরানের সাম্প্রতিক বক্তব্য তার বড় প্রমাণ। পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল পিটিআই চেয়ারম্যান সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি ব্যতীত অন্য কেউ যদি কোনো সেনা কর্মকর্তাকে নতুন সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন, সেক্ষেত্রে পিটিআইয়ের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা ওই সেনাপ্রধানকে মেনে নেবেন না।
সাধারণ জনগণের মধ্যে ইমরান খান ও পিটিআইয়ের বিপুল জনপ্রিয়তা থাকায় তার এই অবস্থান পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সরকার এবং সেনাবাহিনীকে রীতিমতো অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে বলে সম্প্রতি এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন পাকিস্তানের খ্যাতনামা কূটনীতিক নাজাম সেথি।
দ্য ডিপ্লোম্যাট সাময়িকীতে প্রকাশিত সেই প্রবন্ধে নাজাম সেথি আরও বলেন, এই মুহূর্তে পাকিস্তানে ক্ষমতার দু’টি ভরকেন্দ্র (এপিসেন্টার) গড়ে উঠেছে। তার একটি হলো ইমরান খান, অপরটি— সামরিক বাহিনী।
চলমান এই অবস্থাকে পাকিস্তানের ‘বহুমুখী রাজনৈতিক অসঙ্গতি’ উল্লেখ করে এই পাক কূটনীতিক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর পদ হারানোর পর গত সাত মাসে পিটিআই চেয়ারম্যানের সঙ্গে সেনাবাহিনীর বিবাদ বেড়েছে এবং বর্তমানে তা দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোকে ওলটপালট করে দেওয়ার মতো পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী দ্বারা সবচেয়ে বড় ক্ষতির শিকার যে দল, সেই পিএমএলএন বর্তমানে নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতে সেনাবাহিনীর পক্ষে ‘সাফাই গাইছে’ বলেও প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন সেথি।
পিটিআই কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান এজাজ চৌধুরি দ্য ডিপ্লোম্যাটকে এ ইস্যুতে নিজেদের দলীয় অবস্থান স্পষ্ট করে বলেন, ‘পাকিস্তানের রাজনীতিতে স্টাবলিশমেন্টের (সেনাবাহিনী) সংশ্লিষ্টতার ইতিহাস দীর্ঘকালের এবং সবাই তা জানে। আমরা শুধু বলতে চাই— যখন স্টাবলিশমেন্ট নিজের সীমার মধ্যে থাকা এবং বেসামরিক নেতৃত্বকে মেনে নিতে প্রকৃত অর্থে সম্মত হবে, তখনই দেশে সত্যিকার স্থিতিশীলতা আসবে।’
পাকিস্তানের অন্যান্য রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, ক্ষমতা হারানোর পর ইমরান খানের জনপ্রিয়তার উল্লম্ফণই বর্তমান উদ্ভূত এই সংকটের মূল কারণ। বিভিন্ন জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ১০ এপ্রিলের পর থেকে পাকিস্তানজুড়ে ইমরান খানের জনপ্রিয়তা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি এবং এখনও সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। ফলে জাতীয় রাজনীতিতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে এত বছর ধরে যেসব কৌশল ব্যবহার করে এসেছে সেনাবাহিনী, সেসব আর আগের মতো কার্যকর হচ্ছে না।
তদুপরি, যুক্তরাষ্ট্রের আদেশ মেনে সেনাবাহিনী তাকে পদচ্যুত করেছে বলে ইমরান যে অভিযোগ করে আসছেন, তা ও ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে দেশটির সাধারণ জনগণের কাছে। গত সাত মাস ধরে পাকিস্তানজুড়ে পিটিআইয়ের যত সমাবেশ হয়েছে, সেসবের প্রত্যেকটিই মুখরিত হয়ে উঠেছে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন স্লোগানে।
সেসব স্লোগানের একটি হলো, ‘(পাকিস্তানে) যারা যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র, তারা দেশদ্রোহী’ (আমেরিকা কা যো ইয়ার হ্যায়, গাদ্দার হ্যায়)। পিটিআইয়ের সাম্প্রতিক লংমার্চেও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অহরহ স্লোগান উঠছে।
বর্তমানে পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে সামরিক বাহিনীবিরোধী মনোভাব গড়ে উঠছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে মার্কিন সাময়িকী নিউ লাইন ম্যাগাজিন। মিছিল-মিটিং-সমাবেশ তো বটেই, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সম্প্রতি ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে সামরিক বাহিনী বিরোধী বক্তব্য-কন্টেন্ট-হ্যাশট্যাগ।
‘এমনকি, সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বক্তব্য ও কন্টেন্ট পোস্ট করার অভিযোগে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি অ্যাকাউন্ট বন্ধ ঘোষণা করার পাশপাশি গ্রেপ্তারও করা হয়েছে কয়েকজনকে, কিন্তু কিছুতেই এই গণঅসন্তোষ থামানো যাচ্ছে না,’ বলা হয়েছে নিউ লাইন ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে।